সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫) - SM Textbook

Fresh Topics

Friday, July 28, 2023

সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫)

  সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫)


ভূমিকা: সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রমই, শান্তিপ্রিয়, ও সরল প্রকৃতির এক কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর অঞ্চলের গভীর বনভূমিতে তারা বসবাস করত এবং কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সেখানে কৃষি কাজ করতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলে এই অঞ্চলে কোম্পানির অধীনে আসে। জমিদার ও কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে তারা এই অঞ্চল ত্যাগ করে রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল ও মুর্শিদাবাদের একাংশের বনভূমি পরিষ্কার করে সেখানে বসবাস শুরু করে তারা এই অঞ্চলের নাম দেন দামিন-ই-কো বা পাহাড়ের পাদদেশ।


বিদ্রোহের কারণ: এই অঞ্চলের তারা জমিদার ও সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নানাভাবে জমিদার ও সরকার সরলপ্রান দরিদ্র সাঁওতালদের শোষণ করতে শুরু করে ।

১) সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জঙ্গলাকীর্ণ পাথুরে জমিকে  আবাদি জমিতে পরিণত করেছিল। কিন্তু নতুন ভূমিব্যবস্থা এসই জমির খাজনা ধার্য করা হয় খাজনার হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

২. চড়া হারে খাজনা ছাড়াও জমিদার ইজারাদারদের কর্মচারীরা নানাভাবে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপ শুল্ক আদায় করত যেগুলি মেটাতে তাদের নাজেহাল হতে হতো।

৩. নতুন ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্তে নগদ অর্থের খাজনা মিটাতে হতো তাই তারা মহাজনদের কাছে ফসল বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করত । দেশীয় মহাজনরা তাদের ঋণ দিত এবং অন্যায় ভাবে বেশি সুদ আদায় করত সুদের হার ছিল 50 থেকে 500% একবার ঋণ নিলে জাল থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। এ ঋণের দায়ে তাকে চাষের জমির ফসল জমি বিক্রি করতে হতো এমনকি নিজেকেও তাদের দাসে পরিণত হতে হতো।

৪. বিদেশি মহাজন' ও ব্যবসায়ীরা এখানে নানা জিনিসের দোকান খুলে বসে ।ফসলের বিনিময়ে এসব দ্রব্য চড়া দামে কিনতে গিয়ে তারা সর্বস্বান্ত হত। দোকানদাররা ভুয়া বাটখারায় মালপত্র কেনা বেচা করে তাদের ঠকাতো।

৫. লর্ড ডালহৌসির আমলে রাজমহল রামপুরহাট ভগলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে রেলপথ সম্প্রসারণ এর কাজ শুরু হলে ওই সব অঞ্চলের ইংরেজ কর্মচারী ও ঠিকাদারদের আবির্ভাব হয়। তারা সাঁওতালদের নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করত ।এছাড়া তারা জোর করে সাঁওতালদের হাঁস মুরগি ছাগল এমনকি সাঁওতাল মেয়েদের সম্মানে হাত দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না।

৬. নীলকর সাহেবরা সাঁওতালদের জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করতো।

৭. সাঁওতালরা এতদিন তাদের নিজস্ব আইন দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল ।কিন্তু বাংলার ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে তাদের ব্রিটিশ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের অধীনে আনা হয় ।এই আইন ছিল জটিল এবং এর বিচারও ছিল ব্যয় বহুল ও সময় সাপেক্ষ ।তাদের পক্ষে এসব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

৮. খ্রিস্টান মিশনারীরা নানা অছিলায় তাদের ধর্মান্তরিত করত।

৯. এই বিদ্রোহের পশ্চাতে ধর্মীয় উদ্দীপনা ও বেশ কাজ করেছিল। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানু ঘোষনা করে যে ঈশ্বর তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন ।এ বিদ্রোহে তাদের জয় হবেই ।কারণ স্বয়ং ঈশ্বর তাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন ।এইসব বক্তব্য নিরক্ষর ও কুসংস্কার সাঁওতালদের মনে গভীর আশার সঞ্চার করে এবং তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়।


বিদ্রোহের সূচনা: এইসব অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রথমে তারা বিদ্রোহের পতাকা তুলে ধরে নি। প্রথমে তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করে তারপর আবেদনের মাধ্যমে তাদের সমস্যা মিটবে না বুঝে বিদ্রোহের কথা চিন্তা করে ।সিধু ও কানুর নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন ভাগনা ডিহির মাঠে দশ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে ।৭- ই জুলাই তারা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বহু ও জমিদার কে হত্যা করে ।অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায় তারা পাকুরের রাজবাড়ী দখল করে সিধু কানু ছাড়া চাঁদ ও ভৈরব নামে দুই ভাই এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহীদের সংখ্যা কমে ৫০ হাজারে  পৌছায় তীর-ধনুক নিয়ে বীরযোদ্ধা সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত কার্যত ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। বীরভূম মুর্শিদাবাদের একাংশে বিদ্রোহ বিস্তৃত হয়। অবশেষে 23000 বিদ্রোহীকে হত্যা করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়, সিধু ,কানু ও অন্যান্য নেতার ফাঁসি হয়।


বিদ্রোহের চরিত্র: সাঁওতাল বিদ্রোহ মূলত ছিল কৃষক বিদ্রোহ। বিদ্রোহ কেবল একটি উপজাতি বিদ্রোহ নয় এটি ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী দের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও সাঁওতালদের সঙ্গে স্থানীয় কামার গোয়ালা মুসলিম জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল ।অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে এই বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। সাঁওতাল যুবকরা এই বিদ্রোহের মূল শক্তি হলেও কিশোর, বৃদ্ধ এবং নারীরাও এই বিদ্রোহের সক্রিয় ভূমিকা নেয় । সাঁওতাল নারীরা সন্তান কোলে নিয়ে কারাবরণ করে। এই বিদ্রোহ শুধু জমিদার ও মহাজনদের ছিল না তা স্পষ্ট ছিল ব্রিটিশ বিরোধী।


বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব: সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর পরোক্ষ ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ঐতিহাসিক ডক্টর কালীকিংকর দত্ত, বলেন যে বাংলা ও বিহার ইতিহাসে এই বিদ্রোহ এক নবযুগের সূচনা করে।

১. ড: দত্তের মতে এই বিদ্রোহকে গুরুত্বহীন আঞ্চলিক বিদ্রোহ বলা অনুচিত। এই বিদ্রোহ কেবল সাঁওতালদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না উয়িলিয়াম হান্টার বলেন যে সাঁওতাল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী আধা আদিবাসী শ্রেণী ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যোগ দেয় এই বিদ্রোহে।

২. বিদ্রোহ দমনের পর কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে ।সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করে তাদের পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় ।ঘোষণা করা হয় সেখানে ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না ।এখানে ইউরোপীয় মিশনারি ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। এইভাবে জাতীয় জনজীবন থেকে সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন করে সরকার তাদের অনুন্নত  অবস্থাতে রেখে দেয়।

৩. এই অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারীরা সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যসৃষ্টিতে তৎপর হয়।

৪. ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে, যদি ১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই কঠিন সংগ্রাম কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত। সুপ্রকাশ রায় বলেন এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।

No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();