ফরাজী ও ওয়াহাবি আন্দোলন: - SM Textbook

Fresh Topics

Friday, July 28, 2023

ফরাজী ও ওয়াহাবি আন্দোলন:

  ফরাজী ও ওয়াহাবি আন্দোলন:



ফরাজি  আন্দোলন:-

বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।বাংলার মুসলিম সমাজের উপর এই আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মুসলিমরা।


এই আন্দোলনের প্রবর্তক মৌলবি হাজী শরীয়তুল্লাহ 1781 খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি কলকাতা, মক্কা ও কায়রোয় দীর্ঘকাল কোরআন ও ইসলামি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধর্ম সংস্কারক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।


আন্দোলনের আদর্শ:- আরবি ভাষায় ফরাজী কথার অর্থ হল ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য। শরীয়ত উল্লাহ ঘোষণা করেন যে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলামবিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোরআনের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করে তিনি ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের কথা বলেন ।ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে ।ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে তিনি শত্রুর দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন যে এই দেশ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বাসযোগ্য নয়। তিনি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। অচিরেই বরিশাল, ময়মনসিংহ-ঢাকা ও ফরিদপুরের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মুসলিম চাষী কারিগর ও বেকার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ।এইভাবে বাংলা কৃষকদের মধ্যে এক জাগরণের সৃষ্টি হয় এবং তারা জমিদারের অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সাহসী হয়।


১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে শরীয়ত উল্লাহ মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মোহাম্মদ মুসিন আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দক্ষ সংগঠক ও রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন তার নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলন থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয় ।তিনি ঘোষণা করেন যে জমির মালিক আল্লাহ। সুতরাং জমির খাজনা আদায়ের কোন অধিকার নেই। তিনি তার সমর্থকদের জমির খাজনা দেওয়ার নীলকরদের নীলচাষ না করার এবং বিদেশী ইংরেজদের না মানার আহ্বান জানান ।নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষক তার নেতৃত্বে সমবেত হয়। দুদুমিয়ার প্রধান কার্যালয় ছিল বাহাদুরপুরে তিনি একটি সুদক্ষ গুপ্তচর বাহিনী ও লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। সমকালীন পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে হাজার ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে তার অনুগামী সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার এবং তারা তার নির্দেশে যে কোন কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিল ।অনুগামীদের নিয়ে তিনি অত্যাচারী জমিদারদের কাছারি ও কুঠিতে আক্রমণ চালাতেন।


আন্দোলনের বিস্তার:-ক্রমে এই আন্দোলন ফরিদপুর ও ঢাকা থেকে কুমিল্লা ,ময়মনসিংহ ,খুলনা যশোহর ও দক্ষিণ 24 পরগনার ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃত হয়।  ১৮৩৯ থেকে  ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। দুদুমিয়ার কার্যকলাপে বিচলিত হয়ে নিল জমিদাররা তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। সরকার ও তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে ।১৮৩৮-৪৭  খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত চারবার তাকে বন্দী করা হয় ।কিন্তু তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার মত কাউকে পাওয়া যায়নি বলে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে তার মৃত্যুর পর পুত্র নোয়ামিত্র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজ ও জমিদার বিরোধী কর্মসূচির পরিবর্তে ধর্ম সংস্কারের দিকে নজর দিন এর ফলে এই আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।


আন্দোলনের গুরুত্ব: অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে ফরাজি আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় ভাবযুক্ত হলেও মূলত তো ছিলএকটি কৃষক আন্দোলন ।জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা প্রচার করে দুদুমিয়া কৃষকদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কেবলমাত্র মুসলিমরাই নই হিন্দু কৃষকরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ।নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব হিন্দু বিরোধী মনোভাব ধর্মীয় সংকীর্ণতা বলপূর্বক সাধারণ মানুষকে দলভুক্ত করা অর্থ আদায় করা এবং যথার্থ নেতৃত্বের অভাবে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

ওয়াহাবী আন্দোলন (১৮২৩-১৮৮৫):

উদ্দেশ্য: ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল তারিখ ই মোহাম্মদিয়া অর্থাৎ মোহাম্মদ প্রদর্শিত পথ ।অষ্টাদশ শতকে আব্দুল ওয়াহাব নামে জৈনিক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে প্রচলিত কুসংস্কার গুলি দূর করে প্রদর্শিত পথে ইসলাম ধর্মকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম সম্প্রদায় এবং তার প্রচারিত ধর্মমত ওয়াহাবিবাদ নামে পরিচিত ।ওয়াহাবি কথার অর্থ হল নবজাগরণ ।ভারতে এই আন্দোলনের সূচনা হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। ইসলাম ধর্ম ও সমাজকে সকল কলুষতা থেকে মুক্ত করে কোরআনের যথার্থ নির্দেশ অনুযায়ী ধর্ম ও সমাজ কে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তার পুত্র আজিজ এই সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন সুতরাং সূচনাপর্বে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আন্দোলন এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ।

সৈয়দ আহমদ: শাহ ওয়ালিউল্লাহ এই আন্দোলনের সূচনা করলেও ভারতে এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তর প্রদেশের সৈয়দ আহমদ। তিনি দিল্লীতে শাহ ওয়ালীউল্লাহ এর পুত্র আজিজ এর সংস্পর্শে আসেন এবং ১৮২০-২১  খ্রিস্টাব্দ থেকে ইসলাম ধর্মের কথা প্রচার করতে শুরু করেন ।এরপর তিনি মক্কায় যান এবং সেখানে ওয়াহাবি মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন ।১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসে তিনি ওয়াহাবি আদর্শে ভারতে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। অনেকে বলেন যে আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের সঙ্গে সৈয়দ আহমদের কোন সম্পর্ক ছিল না এবং ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের  মূল নীতিগুলির উদ্ভাবক ছিলেন তিনি নিজেই।

সৈয়দ আহমদের মতবাদ: ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে ফিরে এসে তিনি কিছুকাল পাটনায় অবস্থান করেন তার ধর্ম মতে আকৃষ্ট হয়ে বহু মুসলিম তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ক্রমে তার কোন গ্রামের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এবং তার ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। ফরাজি আন্দোলনের নেতা শরীয়ত উল্লাহর মতোই তিনি ইংরেজ অধিকৃত ভারত কে শত্রু দেশ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তার অনুগামীদের ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের আহ্বান জানান ।ইংরেজ বণিকদের তিনি ভারতীয় স্বাধীনতার প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিতাড়িত করার নির্দেশ দেন ।আসন্ন ধর্মযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি এক সেনা দল গড়ে তোলেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সীতানায় মূল কেন্দ্র স্থাপন করেন। মূলত ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন হলেও ওয়াহাবিরা পাঞ্জাবের শিখদের সঙ্গে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। শিকদের বিরুদ্ধে বালাকোটের যুদ্ধ আহমদ পরাজিত হন ও প্রাণ হারান।


আন্দোলনের প্রসার: সৈয়দ আহমদ এর মৃত্যুর পর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, বাংলা, বিহার, হায়দ্রাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চলেও ওয়াহাভাবি বিদ্রোহ ব্যাপক রূপ ধারণ করে ।ইংরেজদের পাঞ্জাব জয়ের পর ওহাবীদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের সূচনা হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওহাবী ধর্মযোদ্ধা প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে মুলতানি সমবেত হয়। ১৮৫০ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সীতানা ঘাঁটি দখলের জন্য 16 বার আক্রমণ চালিয়ে এই অঞ্চলে 35 হাজার সৈন্য নিয়োগ করেও ওয়াহাবীদের দমন করা সম্ভব হয়নি ।শেষ পর্যন্ত ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমিত হয়।


তিতুমীর: বাংলাদেশের ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমীর। তিনি 24 পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্ভুক্ত হায়দারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।39 বছর বয়সে মক্কায় হজ করতে গিয়ে তিনি সৈয়দ আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন ।ওয়াহাবি আদর্শ গ্রহণ করেন অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী তিতুমীর সুদখোর, মহাজন, ও জমিদারদের হাতে নির্যাতিত মুসলিমদের নিয়ে এক বিরাট সংগঠন গড়ে তোলেন। নির্যাতিত বহু হিন্দু তার সংগঠনে যোগ দেয়। 24 পরগনা নদীয়া, যশোহর ,রাজশাহী-ঢাকা মালদা প্রভৃতি স্থানে তিনি তীব্র আন্দোলন শুরু করেন ।জমিদার নীলকর ও সরকার তার বিরুদ্ধে সমবেত হয় ।তারা একযোগে ওয়াহাবীদের ওপর নানা রকম অত্যাচার করতে থাকে। তিতুমীর বারাসাত বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘোষণা করে নিজেকে বাদশা বলে অভিহিত করেন। বাদুড়িয়ার 10 কিলোমিটার দূরে নারকেলবেরিয়া গ্রামে তিনি একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তার সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তিনি গোবরডাঙ্গা পবিত্র স্থানের জমি তাদের কাছ থেকে পাওয়ার দাবি করতে শুরু করেন এই ঘটনা বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত ।স্থানীয় জমিদার এবং কোম্পানির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না তাদের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় ।অতঃপর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তার বিরুদ্ধে অভিযান করেন কামানের আঘাতে বাঁশেরকেল্লা ধ্বংস হয় তিতুমীর তার কয়েকজন অনুগামী বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন।


আন্দোলনের চরিত্র: ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি বা চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত।নন। ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে বহু হিন্দু আন্দোলনের সমর্থক হলেও তা কখনোই জাতীয় আন্দোলন ছিল না বা এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ছিল না ।হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে সমান অধিকারের লক্ষণীয় এই আন্দোলন গড়ে উঠেনি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনের স্থলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা । ড: কুয়েমুদ্দিন আহমদ তার 'দি ওয়াহাবি মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া' গ্রন্থের এই আন্দোলনে হিন্দু মুসলিম একত্রে অংশগ্রহণ করে এবং এতে সাম্প্রদায়িকতার কোন ভূমিকা ছিল না ।তার মতে এই আন্দোলন ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অঙ্গ এবং আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানো। এই আন্দোলন ছিল জমিদার বিরোধী ও ইংরেজ সরকার বিরোধী গণসংগ্রাম।



No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();