দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বড়ো প্রশ্ন উত্তর। Class 12 political science brought questions answer। Political science suggetion 2023। - SM Textbook

Fresh Topics

Tuesday, July 25, 2023

দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বড়ো প্রশ্ন উত্তর। Class 12 political science brought questions answer। Political science suggetion 2023।

  দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বড়ো প্রশ্ন উত্তর। Class 12 political science brought questions answer। Political science suggetion 2023। 



1. রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা গুলি আলোচনা করো।
 জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থা বর্ণনা করো।

     ভারতবর্ষের সংকটময় অবস্থাতে মোকাবিলা করার জন্য ভারতীয় সংবিধানে ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ব্যাপারে বিশদ ও ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা দিয়েছে। সেগুলি হল,যথা —


(১) 352 নং ধারায় জাতীয় জরুরি অবস্থা :-   ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী বর্তমানে দুটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি 352 নং ধারা অনুসারে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারে। যেমন— (i) সংগঠিত বহিরাক্রমণ বা যুদ্ধ ও (ii) অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সংগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহ


কার্যকর পদ্ধতি :-  1978 সালের 44 তম সংবিধান সংশোধনী আইন অনুসারে জাতীয় জরুরি অবস্থাকে কার্যকর করতে গেলে সংসদের উভয় কক্ষে পৃথকভাবে ঘোষনাটিকে অনুমোদিত হতে হবে। এর জন্য প্রত্যেক কক্ষে সদস্যের অর্ধেক এবং উপস্থিত ভোটদানকারী সদস্যের এক-তৃতীয়াংশের সমর্থন লাগবে। এই জরুরি অবস্থা 1962 ,1971 ,1975 সালে তিন তিনবার ঘোষিত হয়েছে।


(২) 356 নং ধারায় রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা :-   ভারতীয় সংবিধানের 356 নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যদি কোন রাজ্যের রাজ্যপাল অথবা অন্য কোন সূত্র থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা সংবিধানের বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করা হচ্ছে না, তাহলে তিনি সেই রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন এবং সেই রাজ্যের শাসন ক্ষমতা তখন রাষ্ট্রপতির হাতে চলে আসে।

   এই রাজ্যভিত্তিক জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সংসদের উভয়কক্ষ কর্তিক পৃথকভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হয়। অনুমোদিত হলে সেটি ছয় মাসের জন্য এবং পুনরায় অনুমোদিত হলে সেটি আরও ছয় মাসের জন্য অর্থাৎ সর্বমোট 1 বছরের জন্য বলবৎ থাকবে। এই জরুরি অবস্থা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন বার ঘোষিত হয়েছে।


(৩) 360 নং ধারায় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা :-   ভারতীয় সংবিধানের 360 নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে দেশে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যে তার ফলে গোটা দেশ বা তার কোন অংশে আর্থিক সংকট বা সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে,তাহলে তিনি সর্বভারতে আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।

কার্যকর পদ্ধতি :-  আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষনাটিকে দুই মাসের মধ্যে সংসদের উভয় কক্ষে অনুমোদিত হতে হয় এবং তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবৎ থাকে। তবে এই ধরনের জরুরি অবস্থা এখনো পর্যন্ত ঘোষিত হয়নি।


মূল্যায়ন :-   সুতরাং,আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সমগ্র ভারতবর্ষে কেন্দ্রের সর্বময় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয় এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যেন এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়।

     তাছাড়া জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্র, রাজনৈতিক আন্দোলন,নাগরিকদের অধিকার প্রভৃতির ওপর স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়।

     শুধু তাই নয় রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলে রাজ্যের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা সরকারকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।

     আবার রাজনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে কেন্দ্রীয় সরকার অবাধে রাজ্যের অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

     রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা এই সমস্ত সমালোচনা ও ফলাফলের সম্মুখীন হয়ে থাকে।


2. জোট-নিরপেক্ষ বলতে কী বোঝো ?

সংজ্ঞা :-   জোট নিরপেক্ষ বলতে কী বোঝায় এই বিষয়ে অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তাই এ প্রসঙ্গে বারটান বলেছেন যে ‘এই ধারণার মাধ্যমে সেই সকল দেশর পররাষ্ট্রনীতিকে বোঝায় যারা সোভিয়েত সমাজবাদী জোট, মার্কিন পুঁজিবাদ গণতান্ত্রিক জোট কোন জোটে যোগদান করেনি কিন্তু বিশেষ অবস্থার জন্য কোন রাষ্ট্র এই নীতি গ্রহণ করবে।’


মার্শাল টিটো জোট নিরপেক্ষ নীতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন এই নীতি হলো দুই পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীকে পৃথিবীর শ্বাসরুদ্ধকর মেরুকরণ প্রবণতা তথা বিভাজনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা।

      পন্ডিত জহরলাল নেহরু বলেন আমরা সকল প্রকার চিন্তার প্রভাব ও সকল প্রকার আদর্শের সঙ্গে সংযোগ ও বন্ধুত্বকে স্বাগত জানায়। কিন্তু আমাদের নিজেদের পথচলার অধিকারটিকে আমরাই সংরক্ষিত রাখছি।


জোট নিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য

বৈশিষ্ট্য :-  1955 সালের বান্দুং  সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শুভ সূচনার যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি রচিত হয়েছে সেগুলি হল যথা —

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান :-   জোট নিরপেক্ষতা বলতে যেমন নিঃসঙ্গ বোধ ও নিরপেক্ষতাবাদকেই বোঝায় না তেমন আবার দুটি জোটের বাইরে থাকাকেউ স্বীকার করে না। তাই জোট নিরপেক্ষতা হলো সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ বিরোধী এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

বিদেশনীতির রূপকার :-  জোট নিরপেক্ষতা হলো বিদেশ নীতির একটি চাবিকাঠি। তাই জোট নিরপেক্ষতার মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তি জোটের বাইরে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে এবং প্রগতিশীল বিদেশনীতি রূপায়িত করে।

নীরব দর্শক নয় :-  জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি বিশ্বরাজনীতিতে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে চাই না কারণ তারা প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাকে বিচারবুদ্ধি, যুক্তি, বিশ্বশান্তি ও নিরপেক্ষতার প্রেক্ষাপটে বিচার করে সর্বদা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি :-  জোট নিরপেক্ষ তার মধ্যে আছে একটি ঐক্যের বাতাবরণ। তাই জোটনিরপেক্ষকারি রাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তি ও নিরাপত্তার মাতৃ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

জোট বা গোষ্ঠী তৈরী নয় :-  জোট নিরপেক্ষতাই বলা হয়েছে যে নির্জোট ভাবে সবকিছু করতে হবে। তাই কোন দেশ তাদের নিজেদের শক্তি কে বাড়িয়ে তুলতে কোন জোট বা গোষ্ঠী তৈরি করতে পারবে না।

শান্তির উপাসক :-  শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের উত্তেজনা এবং বিরোধের মীমাংসা করা এর উদ্দেশ্য। তাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সহযোগিতার পরিমণ্ডলকে বৃদ্ধি করতে প্রতিশ্রুতি এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধের মীমাংসা করে।

স্বীকৃত উপাদান :-  জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে এবং সার্বভৌমত্বকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি স্বীকৃতি উপাদান হিসেবে স্বীকার করা হয়।


মন্তব্য :-   সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তৃতীয় বিশ্বে অনুসৃত জোট নিরপেক্ষ নীতি হলো বিশ্বশান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের এক পরম কল্যাণকর আদর্শ। এই আদর্শ পৃথিবীর রুদ্ধশ্বাস, সামরিক গোষ্ঠী বা জোটের রাজনীতিকে বর্জন করে বিশ্ব শান্তি ও শান্তি সংহতি চেতনাকে তুলে ধরতে চায়। এই কারণে জোট নিরপেক্ষ নীতি তথা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে এক শান্তিকামী নতুন পথের দিশারী, অভিনব আলোকবর্তি স্বরূপ  এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।


3. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে কী বোঝো ? 

আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি


আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার :- যখন কোন আত্মসচেতন জাতীয় জনসমাজ নিজের পৃথক সত্তা ও জাতির বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজের রাজনৈতিক ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানাই তখন তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলে। One Nation,One State - এটি হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের একমাত্র শ্লোগান বা উদ্দেশ্য। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হলে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে একটি করে জাতীয় সরকার গড়ে উঠবে। ওই সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিটি জাতির অগ্রগতির ধারা অক্ষুণ্ন থাকবে। মাৎসিনি, জে.এস. মিল, উইলসন প্রমুখরা হলেন আত্মনিয়ন্ত্রণের মুখ্য সমর্থক।


আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি

স্বপক্ষে যুক্তি 

     আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষে যে সমস্ত যুক্তিগুলি দেওয়া যেতে পারে সেগুলি হল যথা —

(ক) গণতন্ত্র সম্মত :- আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবী প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রসম্মত। কেননা এই দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জনগণ নিজেদের নির্বাচিত জাতীয় সরকার গঠনের সুযোগ পাবে।

(খ) জাতীয় গুণাবলীর বিকাশ :- প্রতিটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রতিভা, ঐতিহ্য প্রভৃতি থাকে। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ওই জাতির নিজস্ব গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে।

(গ) সভ্যতার বিকাশ :- প্রতিটি জাতির জন্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র ও নিজস্ব সরকার থাকলে সেই জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির চরম উন্নতি ঘটবে। এর ফলে পৃথিবীর সব জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির সাথে সাথে বিশ্ব সভ্যতার বিকাশ ঘটবে।

(ঘ) দেশ প্রেম জাগরন :-  জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে উঠলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিবাদ-বিসংবাদ এর সম্ভাবনা থাকে না। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের মানুষ নিজের প্রাণ অপেক্ষা রাষ্ট্রকে অধিক ভালবাসবে, ফলে দেশপ্রেমের জাগরন ঘটবে।

(ঙ) যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস :-  জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে উঠলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব প্রভৃতি থাকবে না। ফলে পৃথিবীতে বিশ্ব যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক অংশে মুক্ত থাকবে।


আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি 

 আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তির পাশাপাশি বিপক্ষেও একাধিক যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। এই যুক্তি হলো নিম্নরুপ — 

(ক) অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি :- ভৌগোলিক কারণে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই নীতি প্রয়োগ করা হলে প্রাকৃতিক সম্পদের অসম বন্টন হবে এর ফলে অধিকাংশ জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি ব্যাহত হবে।

(খ) সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উদ্ভব :- অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গুলিকে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি ক্রমাগত গ্রাস করে নেবে ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বাস্তবায়িত হলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উদ্ভব হবে।

(গ) বিশ্ব শান্তির বিরোধী :- জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের দাবি কার্যকরী হলে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাবে যা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য করে তুলবে আর এই যুদ্ধ বিশ্বশান্তির বিরোধী।

(ঘ) উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি :- বহুজাতিক রাষ্ট্র ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত হলে সমগ্র পৃথিবীতে অধিকাংশ রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হবে।

(ঙ) বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব ও অকাম্য :- বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে যথেষ্ট ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি বাস্তবায়িত হলে সেই ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে সেইজন্য এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব ও অকাম্য।


  উপরিউক্ত বিপক্ষের বিভিন্ন যুক্তি গুলি থেকে সহজেই বলতে পারা যায় বর্তমান দিনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এর প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। তবে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি যদি কোন পরাধীন জাতির মুক্তির সংগ্রাম হয় তবে তাকে সবসময় সমর্থন করা উচিত।


4. সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান এর মধ্যে আলোচনা করো ?

    সুপরিবর্তনীয় সংবিধান হলো সেই সংবিধান যে সংবিধানকে সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে সংশোধন করা যায়। কিন্তু, যে সংবিধান সংশোধন করার জন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন এর প্রয়োজন হয়, সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে সংশোধন করা যায় না সেই সংবিধানকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলে



পার্থক্য :- সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে যে সমস্ত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় সেগুলি হল যথা —

(১) সংশোধন পদ্ধতির ক্ষেত্রে পার্থক্য :- সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে সংশোধন করা যায়।

          অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে   সংশোধন করা যায় না এই জন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।


(২) মর্যাদাগত পার্থক্য :- সুপরিবর্তনীয় সংবিধান নমনীয় বলে সাধারণ আইন এর তুলনায় সাংবিধানিক আইনের বিশেষ কোনো মর্যাদা থাকে না।

          অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান কে সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে সংশোধন করা যায় না বলে সাংবিধানিক আইনের বিশেষ মর্যাদা থাকে।


(৩) উৎসগত পার্থক্য :-  সুপরিবর্তনীয় সংবিধান সংবিধান সভা বা কনভেনশন দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে রচিত না হয়ে প্রথা, রীতিনীতি, আইনসভা প্রণীত আইন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে।

        অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান সংবিধান সভা বা কনভেনশন দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে রচিত হয়।


(৪) বিধিবদ্ধতার প্রশ্নে পার্থক্য :-  সুপরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত বা অলিখিত দুই হতে পারে। যেমন — ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত এবং নিউজিল্যান্ডের সংবিধান লিখিত।

         অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত হতেই হবে।


(৫) নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে পার্থক্য :-  সুপরিবর্তনীয় সংবিধানকে ইচ্ছামত সংশোধনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ নাগরিক অধিকারের উপর সহজেই হস্তক্ষেপ করতে পারে।

          অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানে এই সুযোগ না থাকায় নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে।


(৬) স্পষ্টতার ক্ষেত্রে পার্থক্য :-  সুপরিবর্তনীয় সংবিধান অলিখিত বলে অস্পষ্ট হয়।

           অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান লিখিত বলে স্পষ্ট হয়।


(৭) গতিশীলতার ক্ষেত্রে পার্থক্য :-  সুপরিবর্তনীয় সংবিধান নমনীয় বলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সহজেই তাল মিলিয়ে চলতে পারে।

           অন্যদিকে, দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান অনমনীয় বলে অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।


   উপরিউক্ত বিষয় গুলির মধ্যে সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের পার্থক্য নিহিত আছে।


5. জাতীয় ক্ষমতার উপাদানগুলি আলোচনা করো।
   অথবা,
 আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলি কি ?


ভূমিকা :- বলাই বাহুল্য যে কোন রাষ্ট্র তার জাতীয় শক্তির ওপর নির্ভর করেই তার বিদেশ নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে থাকে। কোন রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তি কতগুলি উপাদানের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে, সেগুলি হল যথা -


ভৌগলিক উপাদান :- জাতীয় শক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হল ভৌগলিক উপাদান। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূগোলের ভূমিকা বহু পূর্বেই স্বীকৃতি লাভ করেছে। যার ফলে কোন দেশের পররাষ্ট্র নীতি সেই দেশের ভূগোলের দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং বলা যায় যে দেশের ভৌগলিক উপাদান যত বেশি সমৃদ্ধ সেই দেশ তত উন্নতশীল।


প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ুগত উপাদান :- কোন দেশের জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়াগত উপাদানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জলবায়ু মানুষের কর্ম ক্ষমতা নির্ধারণ করে জাতীয় শক্তিকে প্রভাবিত করে থাকে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ তীব্র উষ্ণতা অথবা প্রবল শীতলতা জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য।


জনসংখ্যা :-  জাতীয় শক্তির অন্যতম আরেকটি উপাদান হলো জনসংখ্যা। তাই বলা যায় যে দেশের জনসংখ্যা যত বেশি শিক্ষিত, অভিজ্ঞ এবং সামরিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবে সেই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তত উন্নত হবে।


প্রাকৃতিক সম্পদ :- কোন জাতির শক্তি ও সামর্থ্য সেই জাতির প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে খনিজ সম্পদ, পাহাড়, বনজসম্পদ, বন্যপ্রাণী ও মৃত্তিকার উর্বরতা প্রভৃতিকে  বোঝায়। তাই যে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যত বেশি আছে সেই দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে তত উন্নত।


অর্থনৈতিক বিকাশ :-  কোন জাতির জাতীয় শক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। (অধ্যাপক জোসেফ ফ্রাঙ্কেল অর্থনীতিকে যুদ্ধ ও শান্তি উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় শক্তির পক্ষে একান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।) তাই আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়ন কোন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাপকাঠি রূপে কাজ করে। তাই শিল্পসমৃদ্ধ অর্থনৈতিক উপাদান জাতীয় জীবনের প্রতিটি অংশের সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িত।


সাংগঠনিক কাঠামো :-  জাতীয় শক্তির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সাংগঠনিক কাঠামো। সাংগঠনিক কাঠামোর দিক থেকে সরকার ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের সুদৃঢ় কার্যকলাপ ও দৃঢ়তার ওপরে দেশের জাতীয় শক্তির সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল।


সমাজ মনস্তাত্ত্বিক উপাদান :-  জাতীয় শক্তির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সমাজ মনস্তাত্ত্বিক উপাদান। তাই যে দেশের জনগণ সামাজিক দিক থেকে যত বেশি ঐক্যবদ্ধ সেই দেশের জাতীয় শক্তি ততবেশি সুদৃঢ়। এই কারণে একটি ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি সম্পন্ন দেশ একটি ঐক্যবিহীন জনগণ সম্পন্ন দেশের থেকে অধিকতর শক্তিশালী।


মন্তব্য :-   সুতরাং আমরা বলতে পারি যে কোন দেশের জাতীয় শক্তি তার ভৌগলিক উপাদান, জলবায়ু, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনীতি, সরকার, সামরিক বাহিনী, সমাজ মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি উপাদানের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। যদিও এই উপাদান গুলির কোন একটি আবার কোন দেশের জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করতে সর্বাংশেই সক্ষম নয়। তবুও আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে এই উপাদান গুলির সমন্বয়ে কোন দেশের জাতীয় শক্তি বলিষ্ঠভাবে গড়ে উঠতে পারে। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।


6. গান্ধীর চিন্তা ধারার মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অথবা, রাষ্ট্রচিন্তায় গান্ধীবাদ আলোচনা করো।


    রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দীপশিখা হলো গান্ধীবাদ। মহাত্মা গান্ধীর সত্য, ন্যায়, অহিংসা, ভালোবাসা, সেবা, ধর্মীয় সততা, নৈতিক পবিত্রতা ও মানসিক সহায়তায় ভিত্তিতে রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন। যার ফলে রাজনৈতিক দর্শন তথা গান্ধীবাদ অনুপম বিশেষত্ব লাভ করেছে।


গান্ধীর চিন্তা ধারার মূল বৈশিষ্ট্য

         গান্ধীজীর রাজনৈতিক দর্শনের মূলবৈশিষ্ট্য গুলি হল যথা —


সকল মানুষের ক্ষমতা :-   গান্ধীজী মানবজাতির সমতার চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন তাই গান্ধীজী এই ধর্মীয় সত্যকে তার রাজনৈতিক চিন্তা ধারায় আমদানি করেছেন তিনি রাজনীতিতে ধনী-নির্ধন, অভিজাত - আমাজন, শ্বেতকায় - কৃষ্ণকায়, বুর্জোয়া ও সর্বহারার মধ্যে কোন পার্থক্য নির্দেশ করেননি। তার মতে সবাই সত্যেরই স্ফুলিঙ্গ। তাই তিনি শুধু পাপকে ঘৃণা করবেন, পাপীকে নয়।


অহিংসাকে গ্রহণ :-   গান্ধীজী ছিলেন অহিংসার পূজারী। তাই তার মতে অহিংসা হলো সবল ও সাহসীর অস্ত্র, ভিরু ও দুর্বলের নয়। কারণ অহিংসা নৈতিক ও আত্মশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সত্য, প্রেম-ভালোবাসা, সংযম ও আত্ম বলিদান এর মতো মানবিক গুণাবলী অহিংস ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

সাত্যানুধাবন :-   গান্ধীজী মনে করেন যে জীবনের প্রধান লক্ষ্যই হলো সত্যকে অনুধাবন করা। তাই সত্যকে অনুধাবন করার পথে হিংসা, অবিচার, অন্যায়, মিথ্যা প্রভৃতি হলো প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। তাই জীবন থেকে এদেরকে দূর করে সর্বদা সদাচার ও সৎকর্ম করা একান্ত প্রয়োজন।


সর্বোদয় :-    সর্ব এবং উদয় এই দুটি শব্দ নিয়ে সর্বোদয় গঠিত। সর্বোদয় এর আক্ষরিক অর্থ হলো সকলের কল্যাণ। সর্বোদয় এর মুখ্য উদ্দেশ্য অহিংসা এবং সৎ উপায়ে সাহায্যের এক উন্নত নৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা যেখানে সর্বব্যাপী ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ বিরাজ করে।


অছি সম্পর্কিত তত্ত্ব :-   গান্ধীজীর অছি সম্পর্কিত তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো- সমাজের ধনী ব্যক্তিরা তাদের ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে সম্পদের বাকি অংশটুকু সর্বসাধারণের জন্য দান করবে। তাই অছি ব্যবস্থা ব্যক্তির সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয় স্থির করে দেয় এবং পুঁজিবাদী সমাজে শোষণ ও বৈষম্য দূর করে সমাজে এক নৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।


গ্রামীণ পুনর্গঠন এর ধারণা :-   কৃষিপ্রধান ভারতের উন্নয়নের জন্য গান্ধীজী গ্রাম গুলির উন্নতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাই গ্রামীণ ভারতের পূনর্গঠনের জন্য গান্ধীজী সমব্যয় প্রথার প্রচলন, জমিদারি প্রথার সংস্কার, গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দেন |


রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা :-   রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গান্ধীজী “রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি ঘটানাকে সবচেয়ে ভয়ের চোখে দেখেন।” কারণ রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে হিংসা, বলপ্রয়োগ ও রক্তাক্ত বিপ্লব। তাই তিনি দুঃখ করে বলেন যে মানুষের দুর্বলতার জন্য রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়। তাই গান্ধীজীর মতে রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র হলো রাম রাজ্য


মন্তব্য :-   সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গান্ধীজী ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে কোন ভেদাভেদ টানেননি, বরং তিনি উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্কের কথা প্রচার করেছেন। তাই সৎ ও যথার্থ মানব ধর্মই হল রাজনীতির পরিচালিকা শক্তি এবং এই ধর্ম ও রাজনীতির সমস্ত কলঙ্ক কালিমা দূর করে সুস্থ রাজনৈতিক সমাজ সূচিত করে।



7. উদারনীতিবাদ বলতে কী বোঝো ?

 রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে উদারনীতিবাদ (Liberalism) হলো অন্যতম একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে এর উদ্ভব হলেও নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এটি বর্তমান রূপ লাভ করেছে। রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদারনীতিবাদের জন্ম হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় উদারনীতিবাদ এর অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কতৃত্ববাদ এর বিরোধিতা করা এবং ব্যক্তির অবাধ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতাই হলো উদারনীতিবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

      উদারনীতিবাদের তিনটি রূপ আছে। এগুলি হল — (১) সনাতন উদারনীতিবাদ, (২) নয়া উদারনীতিবাদ, (৩) সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদ। J.S Mill, বেন্থাম, গ্রিন, লেসকি, রবার্ট ডাল প্রমুখরা হলেন উদারনীতিবাদের মুখ্য প্রবক্তা।


উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।

        উদারনীতিবাদের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আছে সেগুলি হল যথা —


স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত :-   উদারনীতিবাদে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা গুলিকে অপরিহার্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। সেইসাথে ব্যক্তির অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার কথাও স্বীকার করা হয়েছে।


রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা :-   উদারনীতিবাদের রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। সেইসাথে জনগণের সম্মতি ও শোষিতে সম্মতির ওপর সরকার গঠনের প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।


পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি :-   উদারনীতিবাদের নাগরিকের পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার গুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জীবনের অধিকার, চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার, ধর্মের ও পরিবার গঠনের অধিকার প্রভৃতি হলো পৌর অধিকার। আর নির্বাচিত হওয়া ও নির্বাচন করার অধিকার হলো রাজনৈতিক অধিকার।


সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন :-   উদারনীতিবাদে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা সরকারের পরিবর্তন শিক্ষিত হয়েছে। এর জন্য অবশ্য বিপ্লব ও হিংসার কথা স্বীকার করা হয়নি।


স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা :-   স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নাগরিকের মৌলিক অধিকার গুলিকে সংরক্ষন করে থাকে। এছাড়াও বিচারব্যবস্থা এখানে সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও অভিভাবক রূপে কাজ করে থাকে।


প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃতি :-   উদারনীতিবাদের জাতি,ধর্ম,বর্ণ, দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শ্বেতকায়-কৃষ্ণকায় নির্বিশেষে সমস্ত সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার প্রদান এর নীতি কে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।


ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি :-   উদারনীতিবাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে জনগণের সম্পত্তির অধিকার না থাকলে তাদের কাজকর্মে উৎসাহ আসবে না এবং এর ফলে দেশের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হয়।


পারিবারিক স্বাধীনতা :-   পরিবারের মধ্যে যে কোন নারী যে কোন পুরুষের মতো পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব প্রকাশের অধিকার যুক্ত। পরিবারের পুরুষের মত নারীরও সম্পত্তির অধিকার, বিভিন্ন চুক্তির অধিকার, ব্যবসা পরিচালনার অধিকার, প্রভৃতি অধিকার থাকবে। তাই পরিবারের মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী সমান মর্যাদা সম্পন্ন।


মন্তব্য :-   সুতরাং আমরা বলতে পারি যে উদারনীতিবাদের অর্থনৈতিক সাম্য উপেক্ষিত হয়েছে এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদকে সমর্থন করা হয়েছে। এর ফলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এমনকি বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাও বাস্তবে ক্ষুন্ন হয়েছে। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্যান্য স্বাধীনতা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে  মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণার প্রসার, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকাশ ও ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে মুক্ত রাখা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ এর গুরুত্ব অপরিসীম।


8. মার্কসবাদের মূল সূত্র গুলি আলোচনা করো?

    আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মার্কসবাদ এক নব দিগন্ত উন্মোচিত করেছে এবং রাষ্ট্রচিন্তার জগতকে করেছে সম্প্রসারিত ও সম্প্রচারিত। এই মতবাদ হল রাষ্ট্র চিন্তার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ। এই কারণে মার্কসবাদ কোন মুনি ঋষির মুখনিঃসৃত বাণী নয়। তাই লেনিন এর মতে মার্কস এর দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালার নাম হল মার্কসবাদ


   মার্কসবাদ মূলত কতগুলি সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যাদের সন্ধান পাওয়া যায় - কাল মার্কস ও এঙ্গেলস এর লিখিত ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ গ্রন্থে এবং মার্কস লিখিত ‘দাস ক্যাপিটাল’ গ্রন্থ থেকে, সেগুলি হল যথা —


দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ :-   মার্কসবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। যে মতবাদ অনুযায়ী বস্তুর অন্তর্নিহিত পরস্পর বিরোধী শক্তিদুটির দ্বন্দ্বের কারণে বস্তু ও বস্তুজগতের পরিবর্তন ঘটে তাকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনুযায়ী বস্তুজগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতা বা শক্তি থাকে যথা - (১) বাদ (Thesis) ,(২) প্রতিবাদ (Anti Thesis)। বস্তুর অন্তর্নিহিত এই বাদ ও প্রতিবাদের চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ বাধলেই বস্তুটি তখন মহাসমন্বয় ধর্মী সমবাদে (Synthesis) তথা নতুন বস্তুতে পরিণত হয়।


ঐতিহাসিক বস্তুবাদ :-   মার্কসবাদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুযায়ী সমাজের ধনী-দরিদ্র তথা শোষক ও শোষিত এই দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণীর চুড়ান্ত বিরোধের পথ ধরে সমাজের পরিবর্তন ঘটে। তাই ইতিহাসে দেখা গেছে যে দাস যুগে দাস ও দাস মালিকদের সংগ্রাম, সামন্তযুগে সামন্ত প্রজা ও সামন্তপ্রভুদের সংগ্রাম এবং আধুনিক পুঁজিবাদী যুগে সর্বহারা ও পুঁজিপতিদের সংগ্রামের পথ ধরে যথাক্রমে দাস যুগ, সামন্তযুগ ও পুঁজিবাদী যুগের পরিবর্তন ঘটেছে।


ভিত্তি ও উপরিকাঠামোগত বিষয় :- মার্কসবাদ অনুযায়ী সমগ্র সমাজ যেহেতু অর্থনীতি তথা উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সেহেতু অর্থনীতি হলো সমাজের ভিত্তি (Base) অনুরূপভাবে ভিত্তি বা ভিতের ওপর নির্ভর করে যা কিছু দাঁড়িয়ে থাকে তাদের বলা হয় উপরিকাঠামো বা Super Stracture। এদিক থেকে অর্থনীতি নামক সমাজের ভিত্তিটির ওপর নির্ভর করে যে সমস্ত কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে তথা ধর্ম, রাজনীতি, শিল্প ও সাহিত্য, শিক্ষা - সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদি এরাই হল উপরিকাঠামো।


উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব :- মার্কসীয় অর্থনৈতিক চিন্তার একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হল উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব। উদ্বৃত্ত মূল্য হল কোন দ্রব্য উৎপন্ন হবার পর বাজারে বিক্রয়লব্ধ অতিরিক্ত অর্থ, অর্থাৎ কোন দ্রব্য উৎপাদনের জন্য তার উপাদান গুলির (জমি, শ্রম, মূলধন, ব্যবস্থাপনা) জন্য ব্যয়িত অর্থই হলো দ্রব্যটির মূল্য। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হয় কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য মূল্য পুঁজিপতি শ্রেণীর দেয় না।


9. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।

অথবা,
 ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয় ও সমিতির নয় আলোচনা করো।


     সরকারের কার্যাবলীকে প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।  যথা- (১)আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্য,(২)শাসন সংক্রান্ত কার্য,(৩)বিচারসংক্রান্ত কার্য। এই তিন প্রকার কার্যাবলি সম্পাদন এর দায়িত্ব যথাক্রমে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এই তিনটি বিভাগের প্রত্যেকেই নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করবে এবং অন্য বিভাগের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তাই সরকারের তিনটি ভগের হাতে তিনটি পৃথক ক্ষমতা নষ্ট করার নীতি হলো ক্ষমতার পৃথকীকরণ বা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি


ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে যুক্তি 


     ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে যে সমস্ত যুক্তিগুলি রয়েছে সেগুলি হল যথা —

নীতিটির বাস্তব প্রয়োগ :-   ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। 1789 সালে ফ্রান্সের গণপরিষদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন একটি অপরিহার্য বলে ঘোষণা করে কিন্তু বর্তমানে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো প্রভৃতি রাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ দেখা যায়।


বিভাগীয় স্বাধীনতার সংরক্ষন :-   ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারের শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ভাবে কাজ-কর্ম পরিচালনায় একে অপরকে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যার ফলে বিভাগীয় স্বাধীনতা সুদৃঢ় হয়।


কর্মকুশলতা বৃদ্ধি :-    ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সরকারের তিনটি বিভাগ নিজ নিজ ঐতিহ্য বজায় রেখে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন কাজ করে চলতে পারে। যার ফলে তাদের কর্মকুশলতা বৃদ্ধি পায়।


স্বৈরাচারীতা রোধ :-   ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি রূপায়িত হলে সরকারের তিনটি বিভাগ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রাই সমমর্যাদার অধিকারী হাওয়াই কোন একটি বিভাগ অপর একটি বিভাগের প্রতি স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করতে পারে না।


দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি :-    ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের ফলে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। যার ফলে তাদের ব্যস্ততম কার্যকর্মের দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়।


ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি 

      ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যেসমস্ত যুক্তিগুলি আছে সেগুলি হল যথা—

বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব :-   সমালোচকদের মতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা আলোচনা করলে দেখা যায় যে সরকারের তিনটি বিভাগ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করে থাকে। তাই ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি অনুসৃত হলে প্রত্যেকটি বিভাগ নিজস্ব কাজের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।


ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবজ নয় :- স্যাবাইন, গিলক্রিস্ট প্রমূখ সমালোচকদের মতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কখনোই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে না। কারণ ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হলো স্বাধীনতার অনুকূল পরিবেশ এবং স্বাধীনতাগামী সদাজাগ্রত জনগণ। তাই কোনো সরকারের পক্ষে সচেতন জনমতকে উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।


জৈব মতবাদ :- জৈব মতবাদের সমর্থকরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির তীব্র সমালোচনা করে সরকারকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ জীব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি যেমন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করতে পারে না তেমনি সরকারি বিভাগ গুলি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাফল্যের সাথে কাজ করতে পারে না।


জনকল্যাণ ব্যাহত হবে :- ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে প্রযুক্ত হলে তিনটি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে বিভাগীয় ক্ষমতা সংরক্ষণের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হবে এর ফলে সংকীর্ণ বিভাগীয় শর্ত এবং সাধারণ শর্ত এবং জনকল্যাণ ব্যাহত হবে।


মন্তব্য :-   সুতরাং কিছু সহজাত ত্রুটি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরন নীতিটির গুরুত্বকে আমাদের স্বীকার করতেই হয়। কারণ সচেতনভাবে এই নীতিটি সরকারি কাজকর্মে সাফল্য আনতে পারে, জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও সংহতিকে  সুরক্ষিত করতে পারে। তাই এই নীতি কে বর্জন নয় সজাগ ও সচেতন ভাবে প্রয়োগ করাই একান্ত কাম্য।


10. রাজ্যপালের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো?

   ভারতের অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল হল রাজ্যের প্রধান। সংবিধান গত ভাবে তিনি রাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধানের সকল ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। ভারতীয় সংবিধানের 154 নং ধারা অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা রাজ্যপালের হাতে ন্যস্ত থাকে। এই ক্ষমতা তিনি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তার অধীন কর্মচারীদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বহন করতে পারেন। তিনি রাজ্য সরকারের কার্যকলাপ সূক্ষ্মভাবে সমাধান করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন।


রাজ্যপালের ক্ষমতা

        রাজ্যপালের হাতে যে সমস্ত ক্ষমতা গুলি আছে সেগুলি হল যথা —

প্রশাসনিক ক্ষমতা :-   রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক কার্যকলাপ রাজ্যপালের হাতে ন্যস্ত থাকে। প্রশাসনিক ক্ষমতার দিক থেকে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ রাজ্য মন্ত্রী সভার সদস্যদের নিয়োগ করে থাকেন।


তাছাড়া তিনি রাজ্যের এডভোকেট জেনারেল, রাজ্য সরকারের চাকরি কমিশনের সভাপতি ও সদস্যগণ এবং রাজ্যের হাইকোর্ট ছাড়া বাকি সকল আদালতের বিচারপতি গণকে নিয়োগ করে থাকেন। এমনকি হাইকোর্টের বিচারপতি গণকে নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।


আইনগত ক্ষমতা :-   রাজ্যপাল হলেন রাজ্য আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি রাজ্য আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে, স্থগিত রাখতে ও সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারেন। এমনকি তিনি রাজ্য আইনসভার নিম্ন কক্ষ বিধানসভাকে ভেঙে দিতে পারেন। তার সম্মতি ছাড়া রাজ্য আইনসভা প্রণীত কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। তিনি প্রয়োজনে জরুরি আইন বা অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন তবে এই ঘোষণাকে বিধানসভার অধিবেশন বসার 6 সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই বিধানসভার অনুমোদন লাভ করতে হয়।


অর্থনৈতিক ক্ষমতা :-   রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাজ্যপাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। যেমন-(i) তার সুপারিশ ছাড়া কোন অর্থবিল পেশ করা যায় না,(ii) তিনি রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যের বাজেট পেশ করার ব্যবস্থা করেন,(iii) বিধানসভায় প্রণীত অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোন বিল তিনি বিধানসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু অর্থবিলে তাকে অবশ্যই সম্মতি জানাতে হয়। তার সম্মতির ভিত্তিতে অর্থ বিলটি আইনে পরিণত হয়। তাই রাজ্যপালের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।


বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা :-   রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে রাজ্যপাল বিচারসংক্রান্ত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। তিনি রাজ্যের হাইকোর্ট ছাড়া অন্যান্য আদালতের বিচারপতি গনকে নিয়োগ করে থাকেন। এমনকি তিনি বিচারসংক্রান্ত ক্ষেত্রেও বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। যেমন-(i) তিনি অপরাধীর অপরাধ মার্জনা করতে পারেন,(ii) দণ্ডিত অপরাধের দণ্ড মওকুফ করতে পারেন, (iii) গুরু দণ্ড প্রাপ্ত অপরাধীর দণ্ড বা শাস্তি লঘু করতে পারেন,(iv) এমনকি তিনি মৃত্যুদণ্ড রদ বা বাতিল করতে না পারলেও এই দন্ডকে তিনি কিন্তু স্থগিত রাখতে পারেন। এভাবে তিনি বিচারসংক্রান্ত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে  থাকেন।


অন্যান্য ক্ষমতা :-   রাজ্যপাল আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন, রাজ্য জরুরি অবস্থা বা রাষ্ট্রপতি শাসন (356 নং ধারা) জারি করা হবে কি না সে ব্যাপারে তিনি রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত জরুরি অবস্থা চলাকালীন তিনি রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকারী। এছাড়াও তিনি রাজ্য আইনসভা প্রণীত বিলে সম্মতি না দিয়ে বিলটিকে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তার কাছে পাঠাতে পারেন।


11. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো

      ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার অনুসরণে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতের রাষ্ট্রপতি মর্যাদাসম্পন্ন বা Dignified প্রধান এ পরিণত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের 52 নং ধারা অনুযায়ী ভারত রাষ্ট্রের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা নয় ভারতীয় রাষ্ট্রপতি আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। তার এই ক্ষমতা গুলি হল যথা —


প্রশাসনিক ক্ষমতা :-   ভারতের রাষ্ট্রপতি ভারত রাষ্ট্রের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ভারতীয় প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিগণকে নিয়োগ ও অপসারিত করে থাকেন। যেমন— প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগন এবং কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরি কমিশন, অর্থ কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সভাপতি ও সদস্যগণ প্রমুখ। মূলত এই নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা গুলো রাষ্টপতির প্রশাসনিক ক্ষমতার দিকচিহ্ন স্বরূপ।


আইনগত ক্ষমতা :-   ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন কেন্দ্রীয় আইনসভা সংসদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। লোকসভা ও রাজ্যসভার মতো তিনি হলেন সংসদের জৈবিক একক বা অপরিহার্য স্তম্ভ বিশেষ। তিনি সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন স্থগিত রাখেন এবং সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তিনি সংসদের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন এবং উভয় কক্ষে বাণী বা Message প্রেরণ করতে পারেন। তার সম্মতি ছাড়া সংসদ প্রণীত কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না।


সামরিক ক্ষমতা :-   ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন ভারতের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক তিনি ভারতের জল, স্থল ও বিমান বাহিনীর প্রধান ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ করে থাকেন। তার নামে ভারতে যুদ্ধ ঘোষিত হয় এবং শান্তি ঘোষিত হয়, মূলত তাঁর নির্দেশে ভারতের সেনাবাহিনী পরিচালিত হয়।


কূটনৈতিক ক্ষমতা :-   ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন ভারতবর্ষের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি বিদেশে ভারতের কূটনৈতিক দূত ও প্রতিনিধিগণকে নিয়োগ করে থাকেন। তিনি বিদেশি দূত গনকে ভারতে গ্রহণ করেন, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ভারতের স্বার্থ ও দাবি দাবাকে তুলে ধরেন।


অর্থনৈতিক ক্ষমতা :-   ভারতের রাষ্ট্রপতি অর্থসংক্রান্ত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। তার সুপারিশ ছাড়া ভারতে কোন কর(Tax) ধার্য করা যায় না। প্রতিবছর সরকারের আয় ব্যয় সংক্রান্ত বিবরণী বা বাজেটকে সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা তাকেই করতে হয়। তার সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারেনা। সরকারি আয়-ব্যয়কে নিয়ন্ত্রন করার জন্য তিনি মহা নিয়ন্ত্রক ও গণনা পরীক্ষককে নিয়োগ করে থাকেন। তাই তার অর্থনৈতিক ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা :-   ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি গনকে নিয়োগ করে থাকেন। এছাড়াও তিনি কিছু বিচারবিভাগীয় কাজও করেন, যেমন- তিনি অপরাধীর অপরাধ মার্জনা করতে পারেন, তিনি দুর্নীতি ব্যক্তির দন্ড মুকুব করতে পারেন,এমনকি তিনি মৃত্যুদণ্ডকে বাতিলও করতে পারেন।


জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা :-    ভারতীয় রাষ্টপতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা হলো জরুরি অবস্থায় সংক্রান্ত ক্ষমতা। এই ক্ষমতার বলে তিনি অনেকটাই প্রকৃত প্রধান হয়ে উঠতে পারেন। ফলে দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করার জন্য ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। যেমন-

(১) জাতীয় জরুরি অবস্থা :-   ভারতীয় সংবিধানের 352 নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সমগ্র ভারতবর্ষের জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।

(২) রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন :-    ভারতীয় সংবিধানের 356 নং ধারা অনুযায়ী কোন রাজ্যের প্রশাসনের সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙ্গ পড়লে রাষ্ট্রপতি সেই রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচল অবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা বা রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারেন।

(৩) অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা :-    ভারতীয় সংবিধানের 360 নং ধারা অনুযায়ী দেশের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সর্বভারতীয় স্তরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেl


পদমর্যাদা :-    সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী তাই তিনি হলেন ভারতীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তিনি ভারতীয় সংসদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তার সম্মতি ছাড়া সংসদের কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। তিনি সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, বিচারবিভাগীয় প্রভৃতি ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। এমনকি সংবিধান গত ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করার চূড়ান্ত ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। তবে সংবিধান গত ভাবে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হলেও বাস্তবে তিনি কিন্তু নিজের স্বাধীন ইচ্ছামত ভাবে এই সব ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাকে প্রধানমন্ত্রীর সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পরামর্শ ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই ভারতীয় রাষ্ট্রপতি অনেকটাই যেন “জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল বা সোনার খাঁচায় আবদ্ধ পাখি মাত্র।”


মন্তব্য :-    কিন্তু তবুও আমরা একথা অবশ্যই বলতে পারি যে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি যদি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তিত্ববান ও দৃঢ়চেতা সম্পন্ন হন তাহলে তিনি অনেকটাই স্বাধীন হয়ে উঠতে পারেন। যেমন- নিলাম সঞ্জীব রেড্ডি, জৈল সিং, ডক্টর এপিজে আবদুল কালাম প্রমূখ। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে ব্যক্তিত্ববান, দৃঢ়চেতা ও কর্মমুখী রাষ্ট্রপতি নিছক সাক্ষীগোপাল না হয়ে প্রকৃত প্রধান হয়ে উঠতে পারেন।



12. ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো? 

     ব্রিটেনের ন্যায় ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত শাসক প্রধান ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ক্যাবিনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। তাই ভারতীয় শাসন ব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হলেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের 75 নং ধারায়  রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সাধারণভাবে লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করা হয়।


ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী 

        ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে, সেগুলি হল যথা—


লোকসভার নেতা :-    লোকসভার নেতা বা নেত্রী হলেন প্রধানমন্ত্রী। লোকসভার অধিবেশন কখন আহ্বান করা হবে, কতদিন চলবে, কোন কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হবে প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সরকারের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে তিনি লোকসভার নিকট সরকারি নীতি সমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সভায় বিতর্ক চলাকালীন কোন মন্ত্রী কোন রকম অসুবিধার সম্মুখীন হলে তাকে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই অগ্রসর হতে হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো বিল পাসের জন্য তাকে দায়িত্ব বহন করতে হয়।


মন্ত্রিসভা গঠনে ভূমিকা :-   সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগ করেন। সুতরাং,মন্ত্রিসভা গঠনে কার্যত প্রধানমন্ত্রী সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের সময় তাকে কয়েকটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি রাখতে হয়, যেমন- (১) নিজের দলের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিরা যাতে মন্ত্রিসভায় স্থান পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়, (২)সকল রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গুলি যাতে মন্ত্রিসভায় তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়,(৩) মন্ত্রিসভায় তপশিলি জাতি ও অনুন্নত সম্প্রদায়গুলির প্রতিনিধি যাতে স্থান লাভ করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়।


সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা :-   লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাইরে নিজ দল বা মোর্চার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে হয়। দলীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার দায়িত্ব তারই। দল বা মোর্চার মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিনি সেই সকল বিরোধের নিষ্পত্তি করে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সংহতি অক্ষুন্ন রাখেন।


রাষ্ট্রপতি পরামর্শদাতা :-   প্রধানমন্ত্রী হলেন রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভার সংযোগ স্থাপিত হয়। মন্ত্রিসভার যাবতীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে জানান প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব। রাষ্ট্রপতি কিছু জানতে চাইলে তিনি সেই বিষয়ে তাকে জানাতে বাধ্য থাকেন। তথ্যগতভাবে রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের সকল ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যত এই সকল ক্ষমতা ভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে সরকারের উচ্চ পদাধিকারীদের নিযুক্ত করেন।


আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা :-   প্রধানমন্ত্রী ভারতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তেমনি বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে বিবেচিত হন। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের সুনাম ও স্বার্থ রক্ষায় তাকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়। এছাড়া বিদেশি রাষ্ট্রের প্রধাদের তিনি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে স্বেচ্ছা বিনিময় করেন।


নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা :-    ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কাজ করেন। ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল, সর্বোচ্চ ব্যয় নিয়ন্ত্রক, সহ হিসাব পরীক্ষক, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কর্তৃক কমিশনের প্রভৃতি সদস্যদের নিয়োগের সময় রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলেন।


পদমর্যাদা :-    ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা ও মর্যাদাকে কেন্দ্র করে দুটি পরস্পর বিরোধী মতের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অনেকের মতে প্রধানমন্ত্রী সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য, কারণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মন্ত্রিসভা কিংবা ক্যাবিনেট কোনরূপ ভোটাভুটি হয়না।

তথ্যগতভাবে সমগ্র মন্ত্রিসভায় রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করলেও প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হলেন প্রধানমন্ত্রী  আবার অনেকের মতে প্রধানমন্ত্রী সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য নন, কারণ প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভর সিদ্ধান্ত অনুসারে চলতে হয়। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি তাকে কোনো পরামর্শ দিলে তিনি তা মানতে বাধ্য নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যাপক ও বহুমুখী। তবে তার মর্যাদা বহুলাংশে নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের উপর।


13. ভারতের পার্লামেন্টের/ সংসদের/ আইনসভার গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো

     ইংল্যান্ডের মতো ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় আইনসভাকে পার্লামেন্ট বলা হয়। ভারতীয় পার্লামেন্টের দুটি কক্ষ রয়েছে- উচ্চকক্ষের নাম হল রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষের নাম হল লোকসভা। আর সেইসঙ্গে রাষ্ট্রপতি হলেন ভারতীয় পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃত অর্থে ভারতীয় পার্লামেন্ট হল ভারতীয় গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক।


ভারতের পার্লামেন্টের/ সংসদের/ আইনসভার গঠন

    ভারতীয় পার্লামেন্টের গঠন হলো দুই প্রকারের, যথা —

রাজ্যসভার গঠন :-  রাজ্যসভা হল ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ। সংবিধানে বলা হয়েছে যে সর্বাধিক 250 জন সদস্য নিয়ে রাজ্যসভা গঠিত হবে। এর মধ্যে 12 জন সদস্য সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজসেবা, চারুকলা প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হবে। আর অবশিষ্ট 238 জন সদস্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গুলি থেকে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হবে। বর্তমানে রাজ্যসভার মোট সদস্য সংখ্যা 245 জন। পদাধিকারী বলে উপরাষ্ট্রপতি রাজ্য সভায় সভাপতিত্ব করেন। সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ হল 6 বছর। প্রতি 2 বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্যদের অবসর গ্রহণ করতে হয়।


লোকসভার গঠন:-   ভারতীয পার্লাগেন্টের নিম্নকক্ষের নাম হলো লোকসভা। সংবিধানে বলা হয়েছে যে সর্বাধিক ৫৫২ জন সদস্য নিয়ে লোকসভ গঠিত হবে। বর্তমানে লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৫৪৫ জন। এর মধ্য 2 জন ইঙ্গ ভারতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হয়। অবশিষ্টরা অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ। অঙ্গরাজ্য সমূহের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যা 530 জন এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সমূহের প্রতিনিধির সংখ্যা 13 জন।


লোকসভার সদস্যরা লোকসভার প্রথম অধিবেশনে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ বা স্পিকার পদে নির্বাচিত করেন। এই স্পিকার লোকসভা পরিচালনা করেন। এছাড়াও একজন উপাধ্যক্ষ বা সহকারী স্পিকার থাকেন। তিনি স্পিকারের অবর্তমানে যাবতীয় কার্যসম্পাদন করেন। লোকসভার সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ হল 5 বছর জরুরি অবস্থার সময় প্রয়োজন মনে করলে লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ 1 বছর বৃদ্ধি করা যায়। তবে এইসব মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই রাষ্ট্রপতি লোকসভায় ভেঙে দিতে পারেন।


ভারতের পার্লামেন্টের | সংসদের | আইনসভার কার্যাবলী

    ভারতীয় পার্লামেন্টের বা সংসদের যে সমস্ত কার্যাবলী গুলি আছে সেগুলি হল, যথা —

আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা :-   আইন প্রণয়ন করা হলো পার্লামেন্টের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংবিধানের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয় গুলি 3 টি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেমন- (i)কেন্দ্রীয় তালিকা,(ii) রাজ্য তালিকা,(iii) যুগ্ম তালিকা। কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়ে পার্লামেন্ট এককভাবে আইন প্রণয়ন করার অধিকারী। রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে সাধারণ অবস্থায় আইন প্রণয়ন করার অধিকারী রাজ্য আইনসভা। আর যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে পার্লামেন্ট ও রাজ্য আইনসভা উভয় পৃথকভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এছাড়াও জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকলে কোন রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে পার্লামেন্ট রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে।



নির্বাচন ও পদচ্যুত করার ক্ষমতা :-   রাষ্ট্রপতি ও উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের সদস্যরা অংশগ্রহণ করে থাকে। এমনকি রাষ্ট্রপতি উপরাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিগন, নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব পরীক্ষক প্রমূখকে পদচ্যুত করার জন্য পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে।


বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা :-   পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ আইনসভার অবমাননা কিংবা অধিকার ভঙ্গের অভিযোগে পার্লামেন্টের সদস্য এবং সদস্য নন এমন যে কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দানের ব্যবস্থা করতে পারে। এছাড়াও পার্লামেন্ট যে কোন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের হাইকোর্টের ক্ষমতা ও পরিধি সম্প্রসারণ করতে পারে (230 এর 1 নং ধরায়)।


জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা :-   ভারতের রাষ্ট্রপতি 3 ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারে। যেমন- (i) জাতীয় জরুরি অবস্থা (352 নং ধারা),(ii) রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা (356 নং ধারা),(iii) আর্থিক জরুরি অবস্থা(360 নং ধারা)। প্রতিটি জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে লোকসভা ও রাজ্যসভা কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয় অন্যথায় বাতিল হয়ে যায়।


রাজ্য গঠন ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত ক্ষমতা :-   পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন রাজ্য গঠন করতে পারে। কোন অঙ্গ রাজ্যের কোন অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে কিংবা দুই বা ততোধিক রাজ্যকে একত্রিত করতে অথবা কোন একটি রাজ্যের অংশকে অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে।


অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা :-   অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে লোকসভার একক প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন -

(১) যেকোনো অর্থবিল লোকসভাতেই উপস্থাপিত হতে পারে।

(2) কোন বিল অর্থবিল কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন লোকসভার অধ্যক্ষ।

(৩) লোকসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারেনা।

(৪) মন্ত্রীদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি নির্ধারণের দায়িত্ব পার্লামেন্টের।


সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা :-   সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে ভারতীয় পার্লামেন্ট এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য অঙ্গরাজ্য গুলি আইনসভা সমূহের সম্মতি প্রয়োজন। এই বিষয়গুলি হলো- রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিষয় এবং সংবিধান সংক্রান্ত সংশোধন পদ্ধতি পরিবর্তন প্রভৃতি।


মন্তব্য :-   সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লোকসভার হাতে থাকে। কারণ এই সভার প্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত তায় ভারতের লোকসভা ভারতীয় গণতন্ত্রে জনগণের আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক।


No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();