১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী বিদ্রোহ সমূহ (Pre-1857 Revolts And Civil Uprisings)
সূচনা: 1757 খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পরে বাংলা-বিহার-উরিষ্যা কে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে একের পর এক ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত হয় ।যাতে দেশের কৃষক, তাঁতি, কারিগর শিল্পী প্রভৃতি সাধারন মানুষ অংশগ্রহণ করে।
বিদ্রোহের কারণ:
১. ভারতের আধিপত্য স্থাপন ইংরেজদের মূল লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী বাণিজ্যিক স্বার্থ। এই উদ্দেশ্য নিয়েই ভারতে তাদের সকল কার্যকলাপ পরিচালিত হয়।
২. কোম্পানির সরকার প্রবর্তিত নতুন রাজস্ব নীতি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চিরাচরিত বিচারব্যবস্থার স্থলে নতুন বিচার ব্যবস্থা ও আইন কানুন প্রবর্তন এবং ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ভারতবর্ষের মনের তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
৩. 1793 খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই ব্যবস্থার ফলে পুরোনো জমিদারদের জায়গায় বহু নতুন জমিদারের আবির্ভাব হয় যারা প্রজাপীড়নের মাধ্যমে অধিক রাজস্ব আদায়ে তৎপর ছিল। এ সময় গ্রামীণ সমাজে মহাজন' শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে তাদের কাছ থেকে গরিব প্রজারা চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হতো, এবং এর ফলে ঋণগ্রস্তদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়তো।
৪. রায়তওয়ারি ব্যবস্থা ই কোম্পানির নিজেই ছিল জমিদার। রাজস্ব আদায়কারী অধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাত এবং তাদের জমি থেকে উৎখাত করতো। সরকারি নীতির ফলে ভারতের কৃষককূল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়।
৫. শুধু তাই নয় শিল্প বিপ্লবের ফলে বৃটেনের কলকারখানায় ব্যাপকহারে ভোগ্য পণ্য উৎপাদিত হতে থাকে ।এসব পণ্যের বাজার ছিল উপনিবেশ ভারতবর্ষ। ভারতীয় পণ্যের উপর উচ্চ করভর চাপিয়ে সরকার কৌশলে ভারতীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে থাকে ।ভারতের চিরাচরিত ও সমৃদ্ধশালী কুটির শিল্প গুলি ধ্বংস হয়। বেকার কৃষক এবং শিল্পীদের জীবন ঘন অন্ধকার নেমে আসে ,তারা বিদ্রোহে শামিল হয় ।সারা অষ্টদশ ও উনিশ শতক ধরে ভারতের ব্যাপক স্থান জুড়ে একের পর এক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৮৫৭- র মহাবিদ্রোহ ছিল এসব বিদ্রোহের একটি সম্মিলিত রূপ।
সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০):
স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসন শোষণ ও উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় ।এই আন্দোলন সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ নামে পরিচিত ।এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল 1763 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট 40 বছর। 1717 খ্রিস্টাব্দে ঢাকাতে শুরু হলেও অচিরেই তা দাবানলের মত বগুড়া ,মালদা ,রংপুর-দিনাজপুর ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ,কোচবিহার জেলায় সম্প্রসারিত হয় ।এই বিদ্রোহের নায়ক দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ,মজনুসহ ,চিরাগ আলী। মুঘল যুগের মধ্য শেষভাগে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় বাংলা-বিহারের নানা অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কৃষি কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেও তারা সন্ন্যাসী ও ফকির এর পোশাকে ব্যবহার করত। কোম্পানির স্বৈরাচারিনী তাদের বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয় এবং তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলার অত্যাচারিত কৃষক সম্প্রদায় ও মোঙ্গলবাহিনীর কর্মচ্যুত সেনারা। বিদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল প্রায় 50 হাজার তাদের কার্যকলাপ উত্তরবঙ্গ বিহারে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বিদ্রোহীরা কোম্পানির কোটি রাজস্ব দপ্তর ধনী জমিদারদের কাছারি আক্রমন করত ।সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাদের কোন আক্রমণ পরিচালিত হয়নি এই ভয়াবহ বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনী নামে। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এবং এর জন্য দায়ী নেতাদের অভিজ্ঞতার অভাব সাংগঠনিক দুর্বলতা যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদের কথা। বলা হয় বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস বিদ্রোহকে হিন্দুস্থানের যাযাবর অপেশাদার ডাকাতের উপদ্রব বলে চিহ্নিত করলেও এটি ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ। উইলিয়াম হান্টার এডওয়ার্ড ও একে কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন।
রংপুর বিদ্রোহ (১৭৬৩):
1787 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির ইজারাদার দেবীসিংহ অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরের কৃষক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বাংলা তথা ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।পশ্চিম ভারতের ভাগ্যান্বেষী বনিক দেবী সিংহ রংপুরের ইজারাদার নিযুক্ত হয়েছে তাদের উপর কর ধার্য করেন ,যা দেওয়ার ক্ষমতা কারও ছিলনা। অসমর্থ প্রজা ও জমিদারদের উপর নানা অত্যাচার চলত ।তিনি ছোট-বড় বহু জমিদারকে উচ্ছেদ করেন ।এই অবস্থায় 1783 খ্রিস্টাব্দের 18 জানুয়ারি রংপুরের কয়েক হাজার কৃষক নুরুল উদ্দিনের নেতৃত্বে দেবী সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ।হিন্দু মুসলিম ঐক্য বদ্ধ হয়ে রংপুরের সব জায়গা থেকে দেবী সিংহের রাজস্ব কর্মচারীদের বিতাড়িত করে ।বিদ্রোহ অচিরেই দিনাজপুর ও কোচবিহারে ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ,অঞ্চলে সেনাবাহিনী নামে। শেষ পর্যন্ত নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ দমিত হয়। এটি ছিল হিন্দু মুসলিম কৃষকদের মিলিত বিদ্রোহ ল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন গ্রামের শতশত কৃষক নেতা তাদের নেতৃত্বে প্রায় এক লক্ষ কৃষক সম্মিলিত হয়।
কোল বিদ্রোহ (১৮২০-১৮৩৩):
ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী কোলরা হো মু, ওরাও প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভক্ত ছিল ।এই অঞ্চলে তারা স্বাধীনভাবেই বসবাস করত। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে পোড়হাটের রাজা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করেন ও বিপুল পরিমাণে বার্ষিক কর দানে সম্মত হন ।তিনি পার্শ্ববর্তী কোল অঞ্চলটি নিজের বলে দাবি করেন এবং ইংরেজ সরকার তা মেনে নেন । অতপর তিনি কোল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে গেলে কল দের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয় ।তারা রাজকর্মচারীদের হত্যা করে ।তীর-ধনুক বল্লমে সজ্জিত আদিবাসীরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় শেষ পর্যন্ত অরণ্য সন্তানরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় কোলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।রাজস্ব আদায়ের জন্য ছোটনাগপুর অঞ্চল হিন্দু-মুসলিম ইজারা দেওয়া হয় ।রাজস্ব আদায়ের জন্য তাদের অত্যাচার এর সীমা অতিক্রম করে। এই শোষণ ও উত্তোলনের প্রতিবাদে বুদ্ধ ভগৎ , জয়া ভগৎ কোলদের সমবেত করতে থাকে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলায় মুন্ডা ও ওরাও সম্প্রদায়ের কৃষকরা সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে ।এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সিংহভূম হাজারীবাগ ও তালা উপজেলার সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়। জমিদার সভা কোন ইংরেজ কর্মচারী এমনকি আদিবাসী নয় এমন কোনো মানুষই বিদ্রোহীদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি দু'বছর চেষ্টার পর হাজার হাজার আদিবাসী নারী ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে ।১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে।
ফরাজি আন্দোলন:
বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।বাংলার মুসলিম সমাজের উপর এই আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মুসলিমরা।
এই আন্দোলনের প্রবর্তক মৌলবি হাজী শরীয়তুল্লাহ 1781 খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি কলকাতা, মক্কা ও কায়রোয় দীর্ঘকাল কোরআন ও ইসলামি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধর্ম সংস্কারক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
ওহাবী আন্দোলন: ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল তারিখ ই মোহাম্মদিয়া অর্থাৎ মোহাম্মদ প্রদর্শিত পথ অষ্টাদশ শতকে আব্দুল ওয়াহাব নামে জৈনিক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে প্রচলিত কুসংস্কার গুলি দূর করে মোহাম্মদ প্রদর্শিত পথে ইসলাম ধর্মকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন ।তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম সম্প্রদায় ওহাবী এবং তার প্রচারিত ধর্মমত ওয়াহাবিবাদ নামে পরিচিত। ওহাবী কথার অর্থ হল নবজাগরণ। ভারতে এই আন্দোলনের সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইসলাম ধর্ম ও সমাজকে কলুষমুক্ত কোরআনের যথার্থ নির্দেশ অনুযায়ী ধর্ম ও সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও পুত্র আজিজ এই সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন ।সুতরাং সূচনাপর্বে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আন্দোলন এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ।
No comments:
Post a Comment