ভারতের সময় অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কয়েকটি ধারা সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় বড় প্রশ্ন ও উত্তর| প্রশ্নের মান ১,২,৩,৫ |class 7 history question answer 2nd chapter|
অতি-সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর :
1. কোথায় বঙ্গ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়?
উত্তর : ঋকবেদের ঐতরেয় আরণ্যকে প্রথম বঙ্গ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
2. কারা বঙ্গদেশের নাম দিয়েছিলেন ‘বেঙ্গালা’?
উত্তর : ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় ভ্রমণকারী ও বণিকরা এখানে এসেছিলেন। তাঁরাই বঙ্গদেশের নাম দেন বেঙ্গালা।
3. অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কে ছিলেন?
উত্তর : কৌটিল্য।
4. আইন-ই-আকবরি গ্রন্থটি কে রচনা করেন?
উত্তর : আবুল ফজল।
5. কত খ্রিঃ এবং কতবার মাহমুদ উত্তর ভারত আক্রমণ করেন ?
উত্তর : আনুমানিক 1000 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1027 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে মাহমুদ সতেরোবার উত্তর ভারত আক্রমণ করেন।
6. কত খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজি মারা যান?
উত্তর : 1206 খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজি মারা যান।
7. প্রাচীন বাংলার সীমানা কোন কোন নদীর সঙ্গমে সৃষ্টি হয়েছিল ?
উত্তর : ভাগীরথী, পদ্মা ও মেঘনা এই তিনটি নদীর সঙ্গমে প্রাচীন বাংলার সীমানা তৈরি হয়েছিল।
8. বাংলার কোন্ এলাকা বরেন্দ্র নামে পরিচিত ছিল?
উত্তর : বাংলার ভাগীরথী ও করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী অংশ বরেন্দ্র নামে অবিহিত ছিল।
9. কোন্ অঞ্চলকে বঙ্গ বলা হতো?
উত্তর : প্রাচীনকালে গঙ্গা ও ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী অংশ ত্রিভুজের আকৃতির ন্যায় দেখতে ব-দ্বীপ সীমানাকে বঙ্গ বলা হতো।
10. গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ কোথায় অবস্থিত ছিল ?
উত্তর : পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্ভুক্ত চিরুটির কাছে রাজবাড়িডাঙায় প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এর নিকটই ছিল সেকালের গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ।
11. অষ্টম শতকে কারা বাংলা আক্রমণ করেছিলেন?
উত্তর : অষ্টম শতকে কনৌজ এবং কাশ্মীরের শাসক দল বাংলা আক্রমণ করেছিলেন।
12. ‘গঙ্গাইকোণ্ডচোল’ কার উপাধি ছিল ? তিনি কে ছিলেন ?
উত্তর : ‘গঙ্গাইকোণ্ডচোল’ ছিল প্রথম রাজেন্দ্র চোলের উপাধি। তিনি ছিলেন চোলরাজ প্রথম রাজরাজ-এর পুত্র।
13. রাঢ় অঞ্চল বলতে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কোন অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে ?
উত্তর : বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমভাগ, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা, বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি এবং অজয় ও দামোদর নদের মধ্যবর্তী বিরাট এলাকাকে বোঝায়।
14. শশাঙ্কের মুদ্রায় কোন পশুর ছবি লক্ষ্য করা যায়?
উত্তর : শশাঙ্কের মুদ্রায় যে ছবি দেখা যায় সেটি হল বৃষ বা ষাঁড়ের ছবি।
15. গৌড়তন্ত্র কাকে বলে?
উত্তর : শশাঙ্কের শাসনকালে গৌড়ে যে শাসন ব্যবস্থার গঠন হয়েছিল তাকে গৌড়তন্ত্র বলা হয়।
16. শশাঙ্কর মৃত্যুর পর কে কর্ণসুবর্ণ জয় করেন?
উত্তর : কামরুপের রাজা ভাস্করবর্মা।
17. ভাস্করবর্মার পর কে কর্ণসুবর্ণতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর : রাজা জয়নাগ।
18. দন্তিদূর্গ কে ছিলেন?
উত্তর : রাষ্ট্রকূট বংশের রাজা।
19. সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
উত্তর : সামন্ত সেন।
20. অল বিরুণির লেখা কোন্ গ্রন্থ থেকে ভারতের ইতিহাস জানা যায়।
উত্তর : কিতাব অল হিন্দ গ্রন্থ থেকে।
21. কত খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়?
উত্তর : ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে।
22. কোন শাসক দিল্লিতে কে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর : কুতুবউদ্দিন আইবক।
23. বাংলায় কোন্ সময় পালরাজত্ব শেষ হয়ে যায় ?
উত্তর : রামপালের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই বাংলায় পালরাজত্ব কার্যত শেষ হয়ে যায়।
24. বাংলার কোন্ অঞ্চল হরিকেল নামে পরিচিত ছিল?
উত্তর : বাংলার সমতট অঞ্চলের দক্ষিণপূর্ব দিকে আজকের বাংলাদেশের চট্টগ্রামের উপকূল অঞ্চল প্রাচীন যুগে হরিকেল নামে পরিচিত ছিল।
৩। সংক্ষেপে (৩০–৫০ টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও:
(ক) দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টীয় নবম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে বাণিজ্যের উন্নতি কেন ঘটেছিল?
উত্তর: দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টীয় নবম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে বাণিজ্যের উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন লেখ থেকে জানা যায় যে, চেটটি বা বণিকরা পণ্য সাজিয়ে যাতায়াত করতেন। বিভিন্ন বণিক সংগঠন বা সমবায়ের কথাও পাওয়া যায়। এই সংগঠন গুলি বিভিন্ন মন্দিরকে জমি দান করতেন, তার বর্ণনাও দক্ষিণ ভারতে তাম্রলেখগুলিতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চোরদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার বাণিজ্যের ওপর ভারতীয় বণিকদের প্রভাব আস্তে আস্তে বেড়েছিল।
(খ) পাল ও সেন যুগে বাংলায় কি কি ফসল উৎপন্ন হতো? এই ফসল গুলির কোন কোনটি এখনো চাষ করা হয়?
উত্তর: পাল ও সেন যুগে প্রধান ফসল গুলির মধ্যে ছিল ধান, সরষে ও নানা রকমের ফল, যেমন— আম, কাঠাল, কোলা, ডালিম, ডুমুর, খেজুর, নারকেল ইত্যাদি। এছাড়া কার্পাস, তুলো, সুপুরি, এলাচ, মহুয়া ইত্যাদি ফল গুলি উৎপন্ন হতো। ওই ফসল ও ফল প্রায় সবগুলিই এখনো চাষ হয়।
(গ) রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভার সাহিত্যচর্চার পরিচয় দাও।
উত্তর: রাজা লক্ষণ সেন তার রাজসভায় নানা কবি ও সাহিত্যিকগণকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থান দিয়েছিলেন। বিদ্বান ও বিদ্যার প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। পিতা বল্লাল সেনের আরদ্ধ দানসাগর গ্রন্থখানি লক্ষণ সেন সম্পূর্ণ করে নিজের মানসিক উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রসিদ্ধ বাঙালি বৈষ্ণব কবি জয়দেব ও কবি ধয়ী, গোবর্ধন, শরণ, উমাপতিধর প্রভৃতি তার রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। এজন্য একে বলা হত পঞ্চরত্ন।
(ঘ) পাল শাসনের তুলনায় সেন শাসন কেন বাংলায় কম দিন স্থায়ী হয়েছিল?
উত্তর: বাংলায় ৪০০ বছরের বেশি সময় পাল শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী হয়েছিল। কারণ— ১) খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের পরবর্তীকালে পাল রাজারাও জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু বিজয় সেন একসময় পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। ২) পাল আমলে বাংলার গ্রাম কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা বেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু সেন আমলে স্থানীয় গ্রামীণ শাসন অবনীতির পথে এগিয়ে চলেছিল। ৩) শিক্ষাদিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্মচর্চায় পালযুগে যতখানি উন্নত ছিল সেন যুগে ততখানি ছিল না।
৪। বিশদে (১০০–১২০ টি শব্দের মধ্যে) উত্তর লেখো:
(ক) ভারতের সামন্ত ব্যবস্থার ছবি আঁকতে গেলে কেন তা একখানা ত্রিভুজের মতো দেখায়? এই ব্যবস্থায় সামন্তরা কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করত?
উত্তর: ভারতের সামন্ত অবস্থায় ছবি আঁকতে গেলে তা একখানা ত্রিভুজের মতো দেখাই, কারণ— এই সামন্ত অবস্থায় সবার উপরে থাকে রাজা। সবার নিচে থাকে সাধারন জনগণ বা খেটে খাওয়া মানুষজন। আর তাদের ওপর বেশকিছু সামন্ত বা মাঝারি শাসক এবং তাদের উপরে থাকে অল্প কিছু মহাসামন্ত। ফলে এই ব্যবস্থার ছবি ত্রিভুজের মাথা থেকে নিচ অবধি ক্রমশ চওড়া হয়ে গেছে বলে ত্রিভুজের মতো দেখায়। রাজা থেকে জনগণ অবধি রাজস্ব ও শাসনের এই স্তরে স্তরে ভাগ হয়ে যাওয়াকে সামন্ত ব্যবস্থা বলে।
সামন্ত ব্যবস্থাই সামন্ত ও মহা সামন্তদের মধ্যে সবসময় যুদ্ধ ঝগড়া লেগেই থাকতো। সবাই নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত ছিল। অনেক সময় তারা একসঙ্গে জোট বেঁধে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। রাজার ক্ষমতাকে তারা অনেক সময় অস্বীকার করত, মানতে চাইতো না। এর ফলে সেই সময় রাজশক্তির দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে যায়। সামন্ত নেতাদের অত্যাচারী গ্রামের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা নষ্ট হয়েছিল।
(খ) পাল ও সেন যুগের বাংলার বাণিজ্য ও কৃষির মধ্যে তুলনা কর।
উত্তর: পাল ও সেন যুগের বাংলার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য। গ্রামবাসীর প্রয়োজনীয় প্রায় যাবতীয় জিনিসপত্রই গ্রামে তৈরি হতো। সে যুগে বাংলার অর্থনীতিতে বাণিজ্যের গুরুত্ব ক্রমশই কমে এসেছিল। আরব বণিকদের অত্যাচারে বাংলার বণিকরা পিছু হটেছিল। সেই যুগে বাণিজ্যের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে সোনা রুপার ব্যবহার কমে যায়। তার ফলে কড়ি হয়ে গিয়েছিল বেচাকেনার প্রধান মাধ্যম। হস্তশিল্পের মধ্যে কাঠ ও ধাতুর তৈরি দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস, গয়নার কথা জানা যায়। শিল্পীরা বিভিন্ন নিগম বা গোষ্ঠীতে সঙ্ঘবদ্ধ ছিলেন।
পাল যুগে ও সেন যুগে পাল রাজারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ভূমিধান করতেন এবং সেন রাজারা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন। জমিতে মূল অধিকার ছিল রাষ্ট্রের বা রাজাদের তবে কৃষকদের সেই আমলে অবহেলা করা হতো না। রাজারা উৎপন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ কৃষকদের কাছ থেকে কর নিতেন। বনিকরাও রাজাকে কর দিত প্রজারা আত্মরক্ষার তাগিদে রাজাকে কর দিত।
(গ) পাল আমলের বাংলার শিল্প ও স্থাপত্যের কি পরিচয় পাওয়া যায় তা লেখো।
উত্তর: পাল যুগের বাংলার শিল্প ও স্থাপত্যের এক অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। পাল রাজা গনের সাহায্যে নালন্দা, ওদন্তপুর, বিক্রমশিল ও সোমপুরি মহাবিহার গুলি নির্মিত হয়েছিল। পাল যুগের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিহারের প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল। বিক্রমশীল মহাবিহারে মোট ১০৭টি মন্দির ও ৮ টি মহাবিদ্যালয়। মন্দিরের গায়ে পাথরের ফলক থাকতো। এই সকল মাঠের নির্মাণ পদ্ধতি সে যুগের স্থাপত্য কৌশল এর পরিচয়ক। সোমপুরি মহাবিহারএর ভগ্নাবশেষ রাজশাহী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। পাল যুগের স্তুপ, বিহার মন্দিরের নির্মাণ কৌশল ছিল বিভিন্ন ধরনের। পাল যুগের শিল্পরীতিকে প্রাচ্য শিল্পরীতি বলা হয়। এই যুগে নির্মিত কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এগুলি গরম দেখলে পাল যুগের ভাস্কর্য শিল্পের উন্নতির কথা জানা যায়। ধীমান ও তার পুত্র বিট পাল ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর, চিত্রশিল্পী ও ধাতু মূর্তি শিল্পী। ভাস্কর্যের মধ্যে পোড়ামাটির শিল্প সামগ্রী ছিল। এগুলিতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, সমাজ জীবন, ধর্মবিশ্বাস এর ছবি ফুটে উঠেছে।
(ঘ) পাল ও সেন যুগে সমাজ ও ধর্মের পরিচয় দাও।
উত্তর: পাল ও সেন যুগের বাংলার সমাজের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্ন জাতির উদ্ভব। পাল রাজারা ব্রাহ্মণ ছিলেন না তারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। সমাজের সাধারণ মানুষরা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। ভূমিহীন ব্যক্তি ও শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। একাদশ শতকের শেষ দিকে উত্তরবঙ্গে যে কৈবর্ত বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল তা নিঃসন্দেহে নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে সামাজিক প্রতিবাদের দিকচিহ্ন হিসেবে আজও স্মরণীয়।
সেন রাজারা কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে প্রাধান্য দিতেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে বৈদিক ধর্ম ও পৌরাণিক ধর্মের মিশ্রণ ছিল। স্ত্রী লোকেরা নানারকম ব্রত, উপবাস পালন করতো। ইন্দ্র, অগ্নি, কুবের, সূর্য, গঙ্গা, যমুনা, শিব, দুর্গা, কালী পুজো করা হত। ব্রাহ্মণরা অন্যান্য সবার কাজ করতে পারতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ ছাড়া তাদের কাজ কেউ করতে পারতো না। ব্রাহ্মণরা সমাজপতি হিসেবে সুবিধা ভোগ করতেন। সেন যুগে সমাজে আদিবাসী উপজাতি মানুষের কথাও জানা যায়।
সেন রাজাদের আমলে গ্রাম্য শাসনব্যবস্থার অবনতি ঘটেছিল। সেই সময় রাষ্ট্র অসংখ্য ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত ছিল। সেই সময় সমাজ চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল, যথা— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর :
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর :
1. বঙ্গ নামের উল্লেখ কোথায় কোথায় পাওয়া যায়?
উত্তর : বঙ্গ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋকবেদের ঐতরেয় আরণ্যকে। প্রাচীন বাংলায় বঙ্গ বলতে যে অঞ্চলটিকে বোঝানো হতো তা ভৌগোলিকভাবে খুব একটা বড়ো এলাকা ছিল না। প্রাচীন বাংলার জনপদগুলির মধ্যে বঙ্গ ছিল একটি বিভাগ মাত্র। মহাভারত, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কালিদাসের রঘুবংশম কাব্যেও ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই সিরাজের, লেখাতেও বঙ্গ রাজ্যের কথা রয়েছে।
2. ‘বেঙ্গালা’ নামকরণ কারা করেন?
উত্তর : ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় ও বণিকরা বঙ্গদেশে এসেছিলেন। তাঁরা এই দেশের নাম দিয়েছিলেন ‘বেঙ্গালা’। এই বিরাট ভূখণ্ডটি স্বাধীনতার আগে বাংলা বা ভ্রমণকারীবেঙ্গল নামেই পরিচিত ছিল।
3. পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নামকরণ কবে হয়েছিল?
উত্তর : 1947 খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের সময় বাংলার পশ্চিমভাগের নাম হলো পশ্চিমবঙ্গ, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলা নতুন দেশ পাকিস্তানের মধ্যে চলে গিয়েছিল। পরে তার নাম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান, 1971 খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশ হলে তার নতুন নাম হয় বাংলাদেশ।
4. কর্ণসুবর্ণ কোন্ অঞ্চলটিকে বলা হয়?
উত্তর : পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে রাজবাড়িডাঙায় প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। চিনা বৌদ্ধ পর্যটক সুয়ান জাং বিবরণীতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। চিনা ভাষায় এই বৌদ্ধবিহারের নাম লো-টো-মো-চিহ্ন। এর কাছেই ছিল সেকালের গৌড়ের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণ। কর্ণসুবর্ণ স্থানীয়ভাবে রাজা কর্ণের প্রাসাদ নামে পরিচিত। তবে সপ্তম শতকের পরে এই শহরের কথা আর বিশেষ জানা যায় না।
5. সুয়ান জাং কর্ণসুবর্ণ সম্বন্ধে কী মন্তব্য করেছেন তার বিবরণ দাও ?
উত্তর : সুয়ান জাং কর্ণসুবর্ণ সম্পর্কে লিখেছেন যে এই দেশটি ছিল জনবহুল এবং এখানকার মানুষেরা ছিলেন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে জমি ছিল নীচু ও আর্দ্র, এখানে নিয়মিত কৃষিকাজ হয় এবং অঢেল ফুল, ফল পাওয়া যায়। এখানকার জলবায়ু ছিল নাতিশীতোয় এবং এখানকার মানুষজন ছিলেন ভালো ও শিক্ষা-দীক্ষার পৃষ্ঠপোষক। কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধ এবং শৈব উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই বসবাস করত।
6. ‘গৌড়বহো’ বা ‘গৌড়বধ’ সম্বন্ধে কী জানা যায় ?
উত্তর : ‘গৌড়বহো’ প্রাকৃত ভাষায় লেখা একটি কাব্য। কনৌজের শাসক যশোবর্মা বা যশোবর্মনের রাজকবি বাক্পতিরাজ 725 বা 730 খ্রিস্টাব্দে এই কাব্য রচনা করেন। যশোবর্মন মগধের রাজাকে পরাজিত করার পর কবি এই কাব্যটি রচনা করেন। মনে করা হয় মগধের রাজা বলতে গৌড়ের রাজাকেই বোঝানো হয়েছে।
7. কৈবর্ত বিদ্রোহ কী ?
উত্তর : একাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পাল শাসনে কৈবর্ত বিদ্রোহ ঘটে। সেইসময় বাংলার উত্তরভাগে কৈবর্তদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সম্ভবত এরা ছিল জেলে বা নৌকার মাঝি। এই বিদ্রোহের তিনজন নেতা ছিলেন দিব্য, রুদোক ও ভীম। পালরাজ দ্বিতীয় মহীপালের শাসনকালে তাঁর দুর্বলতার সুযোগে দিব্য বিদ্রোহ করেন এবং তা দমন করতে গিয়ে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হন। দিব্য বরেন্দ্র দখল করে রাজা হন। মহীপালের ভাই রামপাল দিব্যকে দমন করে বরেন্দ্র উদ্ধার করতে অসফল হন। পরবর্তীকালে মহীপালের ছোটোভাই রামপাল বাংলা ও বিহারের সামন্ত রাজাদের সহায়তায় কৈবর্ত রাজা ভীমকে পরাজিত ও হত্যা করে বরেন্দ্রসহ বাংলার কামরূপ ও উড়িষ্যার একাংশে পাল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্য গ্ৰন্থে কৈবর্ত বিদ্রোহের বিবরণ পাওয়া যায়।
8. পাল রাজাদের তারিখ সম্পর্কে কী জানা যায় ?
উত্তর : কয়েক বছর আগে মালদহ জেলার হবিবপুর ব্লকের জগজ্জীবনপুরে একটি বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে পাওয়া তামার লেখ থেকে জানা গেছে যে দেবপালের পর তাঁর বড়ো ছেলে মহেন্দ্রপাল (845 থেকে 60 খ্রিঃ) রাজা হয়েছিলেন। মহেন্দ্রপালের কথা জানার পরে দেবপাল পরবর্তী পাল রাজাদের শাসনকালের তারিখ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের ধারণা বদলে গেছে।
9. রাজপুত কারা? এদের সম্বন্ধে কী জানা যায় ?
উত্তর : উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজপুতদের কথা বারবার বলা হয়ে থাকে। এদের দেশ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে হূণ আক্রমণের পরে বেশ কিছু মধ্য এশিয়া উপজাতির মানুষ স্থানীয়দের বিবাহ করে উত্তর পশ্চিম ভারতে বসবাস করতে থাকে। এদের বংশধরদের রাজপুত বলা হয়। তবে রাজপুতরা নিজেদের স্থানীয় ক্ষত্রিয় বলে মনে করত এবং নিজেদের চন্দ্র, সূর্য বা অগ্নি দেবতার বংশধর বলে মনে করত।
10. ভারত ও আরব সভ্যতার যোগাযোগ সম্পর্কে কী জানা যায়
উত্তর : তুর্কিরা এদেশে আসার অনেক আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে ইসলামের প্রথম যোগাযোগ ঘটেছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে আরব বণিকরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে আসতেন। সিন্ধু মোহনায় মালাবারে আরবি মুসলিম বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল। এর থেকে যেমন আরবি বণিকরা লাভবান হয়েছিল তেমনি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শাসকরাও এর থেকে লাভবান হয়েছিল। হিন্দু, জৈন এবং মুসলিম বণিকদের এই বাণিজ্য ধর্মীয় সহিষ্কৃতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
11. খলিফা কারা?
উত্তর : মহম্মদের পর ইসলাম জগতের নেতৃত্ব কে দেবেন এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় মহম্মদের প্রধান চার সঙ্গীরা একে একে মুসলমানদের নেতা নির্বাচিত হন, এদের খলিফা বলা হয়। খলিফা শব্দটি আরবি, এর অর্থ হলো প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারী। প্রথম খলিফা ছিলেন আবুবকর।
12. খিলাফৎ কী ?
উত্তর : ইসলামীয় জগতের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হলেন খলিফা। যেসব অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়েছে সেই অঞ্চলগুলিকে বলা হয় দার-উল ইসলাম। খলিফা হলেন এই দার-উল ইসলামের প্রধান নেতা। তাঁর অধিকারের অঞ্চলকে বলা হয় খিলাফৎ।
13. কোরান কী ?
উত্তর : কোরান হলো ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে কোরান আল্লাহর বাণী।
14. বাংলায় সেন বংশের শাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ?
উত্তর : পাল রাজাদের শাসনের শেষ দিকে বাংলায় সেনবংশের শাসন শুরু হয়। খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই সমগ্র বাংলার উপর পাল রাজাদের কর্তৃত্ব তেমনভাবে ছিল না। কেবল পূর্ব বিহার ও উত্তর বাংলায় পাল শাসন টিকে ছিল। এই সুযোগে সেন বংশের সামন্ত সেন এবং তাঁর পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ় অঞ্চলে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাল শাসনের শেষ দিকে কৈবর্ত বিদ্রোহ সেনদের রাজ্যস্থাপনে সাহায্য করেছিল।
15. প্রথম রাজরাজ ও রাজেন্দ্র চোল এর কৃতিত্ব আলোচনা করো ?
উত্তর : চোল বংশের অন্যতম রাজা প্রথম রাজরাজ ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমানে কেরল, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চোলদের প্রতিপত্তি বাড়ান। প্রথম রাজরাজ-এর পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র কল্যাণীর চালুক্য শক্তিকে পরাজিত করেন, বাংলার পালবংশের বিরুদ্ধে গঙ্গা নদীতীরে এক পালরাজাকে পরাজিত করে তিনি গঙ্গাইকোণ্ডচোল উপাধি নেন। প্রথম রাজরাজ এবং রাজেন্দ্র চোল দুজনেই দক্ষ নৌবাহিনী তৈরি করেন। তার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতীয় বাণিঞ্জ্যকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা চোলদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
16. মহম্মদ ঘুরি সম্বন্ধে যা জানো লেখো ?
উত্তর : মুসলিম তুর্কিরা ভারতের সম্পদের টানে ভারত আক্রমণ করতে উদ্যোগী হয়, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে ঘুরের শাসক মুইজউদ্দিন মহম্মদ বিন সাম বা মহম্মদ ঘুরি ভারতীয় উপমহাদেশে বিজয় অভিযানে আসেন। মহম্মদ ঘুরি ভারতবর্ষের শাসক হতে চেয়েছিলেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে তিনি রাজপুত রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানকে হারিয়ে দেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি মারা যান। ঘুরির অন্যতম সঙ্গী কুতুবউদ্দিন আইবক সেই সময় দিল্লিতে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
17. লক্ষ্মণসেন সম্পর্কে কী জানা যায়-?
উত্তর : বল্লালসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেন আনুমানিক 1179 খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তিনি একজন সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে। তিনি প্রয়াগ, বারাণসী এবং পুরীতে তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি সমগ্র বাংলা জয় করে গৌড়েশ্বর উপাধি গ্রহণ করেন। লক্ষ্মণসেন ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, তাঁর রাজসভায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কবি জয়দেব। লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে 1204/05 খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজি নদীয়া আক্রমণ করেন। লক্ষ্মণসেন এই আক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারার ফলে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান।
18. ধর্মপাল সম্পর্কে যা জান লেখো ?
উত্তর : পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পর আনুমানিক ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন তার পুত্র ধর্মপাল। তিনি পালবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। সুনিপুণ যোদ্ধা ধর্মপাল পাল রাজ্যের বিস্তার ঘটান। সিংহাসনে আরোহণের পর কনৌজকে কেন্দ্র করে যে ত্রিশক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। ধর্মপাল বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর আমলেই বিক্রমশীল মহাবিহার, ও ওদন্তপুরী বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
19. তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করো ?
উত্তর : ঘুরের শাসক মহম্মদ ঘুরি ভারতবর্ষে শাসক হতে চেয়েছিলেন। তিনি ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার ভারত আক্রমণ করেন এবং চৌহান বংশের রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের হাতে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত হন ও পালিয়ে যান। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি আবার তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে তৃতীয় পৃথ্বিরাজ চৌহান পরাজিত ও নিহত হন। ভারতের ইতিহাসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
20. সমতট বলতে বাংলার কোন অঞ্চলকে বোঝানো হত ?
উত্তর : মেঘনা নদীর পূর্বদিকের এলাকা ছিল বাংলার প্রাচীন সমতট অঞ্চল। বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা নোয়াখালি অঞ্চলের সমভূমিকে কেন্দ্র করে এই প্রাচীন সমতট অঞ্চল বিস্তৃত ছিল। মেঘনা নদী সমতটকে বাংলার বাকি অঞ্চল থেকে ভিন্ন করে রাখায় সমতাকে বাংলার সীমান্তবর্তী সীমানা বলে ধরা হত।
টীকা লেখো :
1. দেবপাল : পালবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ধর্মপালের পুত্র দেবপাল । 806 থেকে 845 খ্রিস্টাব্দ, অবধি তিনি রাজ্য শাসন করেন। তাঁর সময়ে উত্তর হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত এবং উত্তর-পশ্চিমে কম্বোজ দেশ থেকে পূর্বে প্রাগজ্যোতিষপুর পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে দেবপালও ত্রিশক্তি সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তিনি কনৌজ, উৎকল, দ্রাবিড় জয় করেন। তিনি এক সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আমলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
2. কৈবর্ত বিদ্রোহ : একাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পাল শাসনে কৈবর্ত বিদ্রোহ ঘটে। সেইসময় বাংলার উত্তরভাগে কৈবর্তদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। সম্ভবত এরা ছিল জেলে বা নৌকার মাঝি। এই বিদ্রোহের তিনজন নেতা ছিলেন দিব্য, রুদোক ও ভীম। পালরাজ দ্বিতীয় মহীপালের শাসনকালে তাঁর দুর্বলতার সুযোগে দিব্য বিদ্রোহ করেন এবং তা দমন করতে গিয়ে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হন। দিব্য বরেন্দ্র দখল করে রাজা হন। মহীপালের ভাই রামপাল দিব্যকে দমন করতে অসফল হন। পরবর্তীকালে রামপাল বাংলা ও বিহারের সামন্ত রাজাদের সহায়তায় কৈ – রাজা ভীমকে পরাজিত ও হত্যা করে বরেন্দ্রসহ বাংলার কামরূপ ও উড়িষ্যার এক দিকে পাল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিত কাব্যে কৈবর্ত বিদ্রোহের বিবরণ মেলে।
3. বল্লালসেন : পাল বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক বল্লালসেন আনুমানিক 1159-79 খ্রিঃ অবধি রাজত্ব করেন। তিনি পালরাজা গোবিন্দ পালকে পরাস্ত করেন এবং গৌড় জয় করেন। বাংলার বিক্রমপুরে তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বল্লালসেন হিন্দু ধর্মের অনুরাগী ছিলেন এবং সমাজে কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। তিনি সমাজ সংস্কার করে রক্ষণশীল, গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য আচার আচরণকে প্রতিষ্ঠা করেন। বল্লালসেন দানসাগর ও অদ্ভুত সাগর নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
4. প্রাচীন বাংলার বঙ্গ অঞ্চলটির ভৌগোলিক অবস্থানের বিবরণ দাও ?
উত্তর : প্রাচীনকালে পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর মাঝে ত্রিভুজের মতো দেখতে বদ্বীপ অঞ্চলটিকে বঙ্গ বলা হত। সম্ভবত ভাগীরথীর পশ্চিম দিকের এলাকাও এর মধ্যে ছিল। পরে ভাগীরথীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত রাঢ় ও সুক্ষ্ণ নামে দুটো আলাদা অঞ্চলের সৃষ্টি হলে বঙ্গের সীমানাও বদলে যায়। খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে বঙ্গ বলতো এখনকার বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুর, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলকে বোঝানো হত।
5. আরব উপদ্বীপ সম্বন্ধে যা জান লেখো ?
উত্তর : ভারতের পশ্চিমে আরব সাগর পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশের পশ্চিমভাগে আরব উপদ্বীপ অবস্থিত। এখানকার অধিকাংশ অঞ্চলই মরুভূমি বা শুকনো ঘাসজমি। এর পশ্চিমে লোহিত সাগর, দক্ষিণে আরব সাগর এবং পূর্বদিকে পারস্য উপসাগর। এখানে বৃষ্টিপাত সামান্য হয়ে থাকে। মক্কা এবং মদিনা এখানকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এখানকার যাযাবর মানুষদের বেদুইন বলা হতো। তারা উট পালন করত এবং খেজুর ও উটের দুধ ছিল এদের অন্যতম খাদ্য। এই মানুষেরা নিজেদের আরব বলে পরিচয় দিত।
রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর :
1. বাংলায় বখতিয়ার খলজির তুর্কি অভিযান এবং শাসনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ?
উত্তর : 1204 খ্রিস্টাব্দের শেষ বা 1205 খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলায় নদীয়া দখল করেছিলেন। এই সময় থেকে বাংলায় তুর্কি শাসন শুরু হয়। এই সময় বাংলার শাসক ছিলেন রাজা লক্ষণসেন। তুর্কিরা প্রায় বিনা যুদ্ধেই নদীয়া দখল করে নেয়। এরপর বখতিয়ার খলজি নদীয়া ছেড়ে লক্ষণাবতী অধিকার করে সেখানে নিজের রাজধানী স্থাপন করেন। সেই সময়ের ঐতিহাসিকরা এই শহরকে লখনৌতি বলে চিহ্নিত করেছেন। লখনৌতি রাজ্যের সীমানা উত্তরদিককে দিনাজপুর জেলার দেবকোট থেকে রংপুর শহর, দক্ষিণদিকে পদ্মানদী, পূর্বে তিস্তা ও বারতোয়া নদী এবং পশ্চিমদিকে তা বখতিয়ার খলজি অধিকৃত বিহার পর্যন্ত সুবিস্তৃত ছিল।
বখতিয়ার খলজি নিজের নতুন রাজ্যকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের জন্য একজন করে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। এই শাসনকর্তারা ছিলেন তাঁর সেনাপতি। বখতিয়ার লখনৌতিতে মসজিদ, মাদ্রাসা এবং সুফি সাধকদের আস্তানা তৈরি করে দেন। 1206 খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজির মৃত্যু হলে বাংলায় তুর্কি অভিযানের একটি অধ্যায় শেষ হয়।
2. হজরত মহম্মদের ধর্মপ্রচার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ?
উত্তর : ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত মহম্মদ 570 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। 610 খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোষণা করেন যে আল্লাহ্ তাঁকে দূত মনোনীত করেছেন। আল্লাহর বাণী সাধারণ মানুষ মহম্মদের থেকেই জানতে পারেন। তাই তাঁকে আল্লাহর বার্তাবাহক বলা হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে মক্কা শহরকে কেন্দ্র করে হজরত মহম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন, বিভিন্ন আরব উপজাতিদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ বন্ধ করার জন্য তিনি একটি বিশ্বাসকে চালু করেছিলেন। এর ফলে উপজাতিগুলির মাধ্যে ঐক্য তৈরি হতে থাকে। তখনকার দিনে প্রতিষ্ঠিত মক্কাবাসীদের ধর্মীয় আচার আচরণের সাথে মহম্মদের ধর্মীয় মতের যথেষ্ট ফারাক ছিল।
622 খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ এবং তাঁর অনুগামীরা মদিনা শহরে চলে আসেন। মক্কা থেকে মহম্মদের মদিনায় গমনকে আরবি ভাষায় হিজরত বলা হয়। পরে ঐ সময় থেকে হিজরি নামে ইসলামীয় সাল গণনা শুরু হয়। দশ বছরের মধ্যে মহম্মদের ক্ষমতা আরব ভূখণ্ডের বিরাট অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। 632 খ্রিস্টাব্দে হজরত মহম্মদ মৃত্যুবরণ করেন।
No comments:
Post a Comment