ভারতীয় অর্থনীতির পরিবর্তিত কাঠামো (The Changing Structure of Indian Economy) ||
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কৃষিকাজ এবং শিল্প-বাণিজ্যে বাংলা তথা ভারত ছিল এক সমৃদ্ধিশালী দেশ। পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলা তথা ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে ইংরেজ শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতকে যথেচ্ছভাবে শোষণ করে ভারতীয় সম্পদ ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া। ড. বিপান চন্দ্র বলেন, “নিজেদের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য ব্রিটিশ জাতি ভারতের জন্য এক নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থা উদ্ভাবন করে। যতদূর সম্ভব ভারতের অর্থ শুষে নিয়ে ব্রিটিশের স্বার্থে তা কাজে লাগানোই ছিল ব্রিটিশের মূল লক্ষ্য।” স্বভাবতই ইংরেজদের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতি ভারতের চিরাচরিত সমৃদ্ধিশালী কৃষি ও শিল্পকে ধ্বংস করে এবং এর ফলে ভারতের গ্রামীণ সমাজ ভেঙে পড়ে। বণিক, শিল্পী, কৃষক, জমিদার, সাধারণ মানুষ সবার জীবনে পরিবর্তন আসে।
সম্পদের নির্গমন
সম্পদ নির্গমনের অর্থ : পলাশির যুদ্ধের পর রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণে সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে চলে যায় এবং এর বিনিময়ে ভারত কোনো উপযুক্ত সুযোগসুবিধা পায়নি। ঐতিহাসিকরা এই ঘটনাকে সম্পদের নির্গমন, আর্থিক নিষ্ক্রমণ, আর্থিক নির্গমন' বা 'Drain of wealthy' বলে অভিহিত করেছেন। বুকস অ্যাডামস্ এই ঘটনাকে 'পলাশি লুণ্ঠন' (Plassey Plunder) বলে আখ্যায়িত করেন। © সম্পন্ন নির্গমনের নানা পদ্ধতি। এই নির্গমন হয়েছিল দুটি ধারার। (১) বেসরকারি- ভাবে কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজ বণিকদের ছারা বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন এবং তা ইংল্যান্ডে পাচার। (২) কোম্পানির বাণিজ্য, আর্থিক ও রাজস্ব নীতির ফলে বাংলার সম্পদের নির্গমন।
কোম্পানির কর্মচারীদের মাধ্যমে: (ক) ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধজয়ের পর থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভ পর্যন্ত কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীরা উৎকোচ, উপঢৌকন, নজরানা ও অন্যান্য সূত্রে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। পলাশির যুদ্ধের পর "নবার তৈরির ব্যবসায় নেমে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। বাংলায় ঢালাও লুণ্ঠন চলতে থাকে। ড. পার্সিভ্যাল স্পিয়ার (Dr. Perceval Spear) পলাশি-পরবর্তী যুগকে 'প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ' (Age of open and unashamed plunder) বলে অভিহিত করেছেন। (খ) ১৭৫৭ থেকে ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত অবাধ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর উপার্জন করে এবং তা ইংল্যান্ডে পাঠায়। ড. নরেন্দ্রকৃন্ন সিংহ বলেন যে, উৎকোচ ও নজরানা অপেক্ষা কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত আয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। (গ) বিভিন্ন প্রকার গোপন ও অবৈধ চুক্তি এবং ঠিকাদারির মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর আয় করত। এ ব্যাপারে। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন তুলনাহীন। 'বোর্ড অফ ট্রেড-এর সদস্যরাও নানা দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগার করতেন। কোম্পানির মাল কেনার সময় তাঁরা গরিব চাষি, তাঁতি ও দেশীয় বণিকদের কাছ থেকে বলপূর্বক কমিশন আদায় করতেন।
কোম্পানির মাধ্যমে কোম্পানিও সরকারিভাবে সম্পদের নির্গমন ঘটাত। (ক) পলাশির যুদ্ধের পূর্বে কোম্পানি ভারত থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি ক্রয় করে তা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। এজন্য কোম্পানিকে নিজের দেশ থেকে সোনারূপা আমদানি করতে হত। পলাশির যুদ্ধ, বিশেষ করে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানির হাতে বাংলার রাজস্বের যে-বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, কোম্পানি সেই অর্থই বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। এইভাবে বাণিজ্যিক লগ্নি মারফত বাংলার টাকা বাইরে চলে যায়। (খ) কোম্পানির অংশীদারদের 'ডিভিডেন্ড', ব্রিটিশ সরকারের প্রাপ্য অর্থ, ভারতের প্রশাসনিক ব্যয়, ইংল্যান্ডে ইন্ডিয়া অফিস-এর বায়, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রশাসনিক ব্যয় ও বাণিজ্যিক লখি—সবই মেটানো হত বাংলার রাজস্ব থেকে।
নির্গমনের পরিমাণ : এইভাবে ভারত থেকে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ ইংল্যান্ডে গেছে তার সঠিক হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে নানা পণ্ডিত নানা ধরনের হিসাব দিয়েছেন। মাদ্রাজের রাজস্ব বোর্ডের সচিব জন সুলিভ্যান (John Sullivan) বলেন, "আমাদের শাসনব্যবস্থা অনেকটা স্পন্নের মতো। গঙ্গা-তীরবর্তী দেশ থেকে এই স্পধর্মী শাসন যা কিছু সম্পদ সব শুষে নেয় এবং টেমস্-তীরবর্তী দেশে এনে তা নিংড়ে দেয়।”
উপসংহার: দাদাভাই নওরোজি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকের মতে, ভারতের দারিদ্রোর মূল কারণ হল ভারতীয় সম্পদের নির্গমন। অপরপক্ষে, ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার জন স্টাচি, স্যার থিওডোর মরিসন, পি.জে. মার্শাল নির্গমন তত্ত্ব মানতে রাজি নন। বলা বাহুলা, নির্গমন তার একটি বাস্তব ঘটনা। রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, পৃথিবীর কোনো দেশে সম্পদ নির্গমনের এত ন্যাকারজনক উদাহরণ আর দেখা যा না।
অবশিল্পায়ন
সূচনা: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সর্বাপেক্ষা কুফল হল ভারতের চিরাচরিত ও ঐতিহ্যমণ্ডিত কুটিরশিল্প বা হস্তশিল্পের ধ্বংসসাধন। এই ঘটনা 'অবশিল্পায়ন' বা 'De-industrialisation' নামে খ্যাত। দাদাভাই নওরোজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রাখাতে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী লেখক এ ব্যাপারে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাডগিল, বি. ডি. বসু, ড. নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, ড. বিপান চন্দ্র, ড. অমিয় বাগচি প্রমুখ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
সুতিবস্ত্রের ওপর আক্রমণ: অষ্টাদশ শতকে ভারত ছিল এক শিল্প-সমৃদ্ধ দেশ। বিদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যাদির চাহিদাও ছিল ব্যাপক। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে ভারতের রেশম ও সুতিবস্ত্র প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর ফলে ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কলকারখানায় মন্দা দেখা দেয় এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। ব্রিটিশ শিল্পপতিদের চাপে ১৭০০ এবং ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে আইন পাস করে ভারতীয় বস্ত্রাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। ১৭৪৭, ১৭৫৯ এবং ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে আমদানিকৃত ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কোম্পানির দালালরা এদেশের তাঁতিদের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে একমাত্র কোম্পানির জন্যই সুতিবস্ত্র বুনতে বাধ্য করে। এজন্য তারা তাঁতিদের জোর করে অগ্রিম নিতে বাধ্য করত। অগ্রিম নেওয়া তাঁতি লোকসান স্বীকার করে বাজার দরের চেয়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ কম মূল্যে তার বস্ত্র কোম্পানিকে বিক্রি করতে বাধ্য হত। তাঁতিরা আগে দক্ষিণ ভারত থেকে তুলো আমদানি করত, কিন্তু কোম্পানি পরে নিজেই সেই তুলোর সবটা কিনে নিয়ে মন প্রতি ১৪/১৫ টাকা বেশি দামে ওই তাঁতিদের তা কিনতে বাধ্য করে। এর ফলে তাঁতিরা বেশি দামে তুলো কিনে কম দামে বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এইভাবে কেনা ও বেচা দুদিকেই তাদের ক্ষতি স্বীকার করতে হত। এই লোকসান ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাজার হাজার তাঁতি দেশত্যাগ করে এবং অনেকে দায়িত্ব এড়াবার জন্য নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে ফেলে। এর ফলে সমৃদ্ধ জনপদগুলি শ্রীহীন ও জনশূন্য হয়ে পড়ে।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের পর উন্নত মানের ও সস্তা দামের ব্রিটিশ পণ্যাদি জলস্রোতের মতো ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে ইংল্যান্ড-জাত দ্রব্যগুলি বিনা শুল্কে ভারতে প্রবেশ করে এবং দেশে- বিদেশে সর্বত্র ভারতীয় পণ্যাদির ওপর বিরাট করের বোঝা চাপানো হয়। এই অস প্রতিযোগিতায় ভারতীয় শিল্পগুলির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। এর ফলে কেবলমাত্র সুতিবস্ত্রই নয়— রেশম ও পশমজাত দ্রব্যাদি, লোহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার, খোদাই ও কারুকার্যের সলো জড়িত বিভিন্ন দেশীয় শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ভারত পরিণত হয় ইংল্যান্ডের কারখানাগুলির খোলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে।
ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের কারণ: ভারতীয় শিল্পের ফাংসের জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করা হয়। (১) সপ্তা দামের বিদেশি পণ্যের আমদানি, (2) ধনী ও মধ্যবিত্ত নাগরিকদের বিদেশি পণ্যের প্রতি ঝোঁক, (৩) দেশীয় শিল্পের পৃষ্ঠপোষক দেশীয় রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদে বিলুপ্তি, (ঞ) ইংল্যান্ডে শিল্পবিচার, শিল্পপণ্যের বিপুল উৎপাদন এবং ভারতে তার অব্যাহত জোয়ান, "(e) ভারতীয় ঔপনিবেশিক বাজারে নিজের শিল্পবা একচেটিয়া বিক্রির অপতা, (৬) ব্রিটিশ বণিক ও পুঁজিপতিদের এদেশ থেকে শিল্পপণ্যের পরিবর্তে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল (যথা— সুতিবন্ধের পরিবর্তে তুলে, রেশমবন্ধের পরিবর্তে কাঁচা রেশম ইত্যাদি) সংগ্রহের নীতি এবং (৭) সর্বোপরি, ব্রিটিশ সরকারের সংরক্ষণ শুল্ক নীতি । রাসবুক উইলিয়মস, হ্যামিলটন প্রমুখের মতে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবই ছিল ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের মূল কারণ—এর জন্য ব্রিটিশ সরকার দায়ী ছিল না। যন্ত্র ও হস্তশিল্পের মধ্যে বিরাট ব্যবধানই এর কারণ। অপরপক্ষে, রমেশচন্দ্র দত্ত ব্রিটিশ সরকার অনুসৃত নীতিকেই দায়ী।
ফলাফল: ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। (১) ভারত একটি রপ্তানিকারী দেশ থেকে আমদানিকারী দেশে পরিণত হল। (২) তৈরি করা পণ্যাদির (finished goods) পরিবর্তে ভারত থেকে রপ্তানি হতে লাগল কাঁচা তুলো, নীল, রেশম, চা প্রভৃতি। ভারত পরিণত হল ব্রিটেনের কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে। (৩) শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেল। বেকার শ্রমিকরা কৃষিক্ষেত্রে ভিড় করায় জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। (৪) শিল্প-সমৃদ্ধ ও ঘনবসতিপূর্ণ নগরগুলি ক্রমে জনবিরল স্থানে পরিণত হয়। (৫) চিরাচরিত অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ায় ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ভারতীয় জীবনের অঙ্গে পরিণত হয়।
অবশিল্পায়ন—অলীক ধারণা: বিদেশি ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল থর্নার (Daniel Thorner), মরিস ডেভিড মরিস (Morris David Morris), স্যার থিওডোর মরিসন (Theodore Morrison) প্রমুখ 'অবশিল্পায়ন' তত্ত্ব মানতে রাজি নন। মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস এর মতে, অবশিল্পায়নের পুরো ব্যাপারটিই হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের দ্বারা বহুল প্রচারিত একটি নিছক 'অলীক কল্পনা' বা 'myth'। অপরপক্ষে, ড. অমিয় বাগচি, ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. তপন রায়চৌধুরী, ড. ইরফান হাবিব, ড. বিপান চন্দ্র প্রমুখের মতে, অবশিল্পায়ন একটি বাস্তব সত্য। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ-এর মতে, নো যুক্তি দিয়েই অবশিল্পায়নের ঘটনাটি অস্বীকার করা যায় না।"
No comments:
Post a Comment