ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর আবির্ভাব (Emergence of a Colonial Structure of Government) |রেগুলেটিং অ্যাক্ট পিটের ভারত শাসন আইন |সিভিল সার্ভিস |ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ| - SM Textbook

Fresh Topics

Monday, September 18, 2023

ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর আবির্ভাব (Emergence of a Colonial Structure of Government) |রেগুলেটিং অ্যাক্ট পিটের ভারত শাসন আইন |সিভিল সার্ভিস |ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ|

  ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর আবির্ভাব (Emergence of a Colonial Structure of Government) |রেগুলেটিং অ্যাক্ট পিটের ভারত শাসন আইন |সিভিল সার্ভিস |ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ|





পটভূমিঃ কোম্পানি প্রথমদিকে তার অধিকৃত অঞ্চলের শাসনভার ভারতীয় কর্মচারীদের ওপরেই ন্যস্ত রেখেছিল। নিজেরা শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করে তার ওপর মোটামুটি নজর রাখত। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় দেওয়ানি-সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। এর অনেক আগেই মিরজাফরের পুত্র নজম-উদদৌলার সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে নবাব কোম্পানি মনোনীত "নায়ের নাজিম'-এর হাতে তাঁর সব 'নিজামতি' বা প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্ব অর্পণ করে কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। এইভাবে কোম্পানি 'নিজামত' ও 'দেওয়ানি' সকল ক্ষমতার অধিকারী হয়। মহম্মদ রেজা খাঁ ও সিতাব রায় যথাক্রমে বাংলা ও বিহারের নায়ের নাজিম' বা 'নায়ের-সুবা' (ডেপুটি সুবাদার) নিযুক্ত হন। তাঁদের হাতে বাংলা ও বিহারের নিজামত ও দেওয়ানি বিভাগের সকল দায়িত্ব অর্পিত হয়। তাঁরা আইনত নবাবের অধীনস্থ হলেও তাঁদের প্রধান কাজ ছিল কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা। নবাবের নামে শাসনকার্য পরিচালিত হলেও কার্যত তিনি ছিলেন শরিহীন এবং ইংরেজ কোম্পানিই ছিল সর্বেসর্বা। এই শাসনব্যবস্থা 'দ্বৈত শাসন' নামে পরিচিত ছিল। 'দ্বৈত শাসন' বাংলার বুকে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করে। দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা বাংলার সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়।


 রেগুলেটিং অ্যাক্ট: বড়োলটি ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রেগুলেটিং আইন (Regulating Act) পাস করে কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এই আইন দ্বারা বাংলার গভর্নর 'গভর্নর জেনারেল' বলে অভিহিত হন। গভর্নর জেনারেল ও আরও চারজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত একটি 'কাউন্সিল' বা উপদেষ্টা পরিষদের হাতে বাংলার শাসনভার অর্পিত হয়। বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি সব ব্যাপারে বাংলার গভর্নর জেনারেলের কর্তৃত্বাধীন ছিল। এই আইন অনুসারে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার ইলিজা ইম্পে সুপ্রিমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। এসত্ত্বেও কিন্তু কোম্পানির প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হয়নি।


 পিটের ভারত শাসন আইন: রেগুলেটিং আইনের অসুবিধাগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি নতুন আইন প্রবর্তন করে। এর নাম 'পিটের ভারত শাসন আইন'। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়ম পিট এই আইনটি প্রবর্তনে উদ্যোগী হন বলে, তাঁর নাম অনুসারে এই আইনটির নামকরণ হয়। এই আইন দ্বারা বাংলার গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং প্রশাসনিক বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।


কোম্পানির শাসন প্রবর্তন: এইসব ব্যবস্থায় তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ঠিকভাবে চরিতার্থ না হওয়ায় কালক্রমে কোম্পানি নিজের হাতে পুরো শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে নতুন নতুন স্থানে কোম্পানির আধিপত্য বিস্তৃত হওয়ায় নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হচ্ছিল। এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল বিজিত স্থানগুলিতে আইন-শৃঙ্খলা স্থাপন এবং কোম্পানির শাসনের স্থায়িত্ব বিধান করা, কারণ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত ইংরেজ বণিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হত এবং তাদের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হত। এইসব কারণে সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখেই কোম্পানি ভারতে একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। ড. বিপান চন্দ্ৰ (Dr. Bipan Chandra) বলেন যে, “ভারতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা তিনটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল—সিভিল সার্ভিস, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ।” (“The British administration in India was based on three pillars: the Civil Service, the Army and the Police-Modern India, Bipan Chandra, P. 107.)। এ প্রসঙ্গে আর একটি স্তম্ভ বিচারব্যবস্থার কথাও বলা যায়। নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতি হিসেবে এ সময় ভারতে নতুন নতুন বৃত্তিরও উদ্ভব ঘটে।

সিভিল সার্ভিস 

 সূচনাপর্ব : পলাশির যুদ্ধের পূর্বে ফ্যাক্টর (Factor), রাইটার (Writer), অ্যাপ্রেন্টিস (Apprentice) প্রমুখ কর্মচারী কোম্পানির বাণিজ্যিক কাজকর্মে নিযুক্ত ছিল। বেতন কম পেত বলে এইসব কর্মচারী ব্যক্তিগত বাণিজ্যও, চালাত এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি ছিল না। পলাশির যুদ্ধের পর এইসব কর্মচারীর ওপর কিছু প্রশাসনিক দায়িত্বও অর্পিত হয় এবং তারা একই সঙ্গো বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকে। এ সময় তারা খুবই দুর্নীতিপরাল হয়ে ওঠে। ক্লাইভ এবং ওয়ারেন হেস্টিংস এইসব দুর্নীতি দমনের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেননি।


 দুর্নীতি দমন লর্ড কর্ণওয়ালিস (১৭৮৬-৯৩ খ্রি.)-কে ভারতে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের প্রকৃত প্রবর্তক বলা যায়। প্রশাসনকে সৎ, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য তিনি বেশ কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। (১) তিনি কোম্পানির বাণিজ্য ও রাজস্ব দপ্তরকে পৃথক করেন এবং রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের শাসনকার্য পরিচালনা ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে দ করে তুলতে প্রয়াসী হন। (২) কর্মচারীদের স্থানীয় ভাষা শিক্ষায় উৎসাহ দেওয়া হয়। (৩) কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাবসা, উৎকোচ ও উপটৌকন গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন এবং সৎ ও সচ্ছলভাবে জীবনযাপনের জন্য তাদের বেতন বৃদ্ধি করেন। কর্নওয়ালিসের আমল থেকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা পৃথিবীর যে-কোনো দেশ অপেক্ষা উন্নত ছিল ("The Company's servants became the best paid civil service in the world"-The Oxford History of Modern India, Perceval Spear, 1997, P. 179.)। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য তিনি যেসব বিধি প্রণয়ন করেন তা কর্নওয়ালিস কোড' নামে পরিচিত।


 ভারতীয়দের নিয়োগে বাঁধা সে: লর্ড কর্নওয়ালিস যে-কোনো উচ্চ সরকারি পদে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করেন। তিনি মনে করতেন যে, হিন্দুস্থানের প্রতিটি মানুষই দুর্নীতিপরায়ণ ("Every native of Hindustan is corrupt")। এই কারণে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে নিয়ম করা হয় যে, বছরে ৫০০ পাউন্ডের বেশি বেতনের চাকুরিতে কোনো ভারতীয়কে নিয়োগ করা হবে না। কেবলমাত্র সিভিল সার্ভিস নয়—সরকারি চাকুরির সবক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য ছিল। বলা বাহুল্য, কর্নওয়ালিসের এই সিদ্ধান্ত নঠিক ছিল না, কারণ এই ধরনের বক্তব্য ইংরেজ কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। তাদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্যই তিনি তাদের বেতন বৃদ্ধি করেন, অথচ ভারতীয়দের জন্য সেরকম কোনো পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেননি।


ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ: বড়োলাট লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৯৮-১৮০৫ খ্রি.) উপলব্ধি করেন যে, ইংল্যান্ড থেকে আগত তরুণ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে 'ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ' প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানির পরিচালকবর্গের আপত্তিতে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পরিবর্তে ইংল্যান্ডের হেইলেবেরি নামক স্থানে ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজ স্থাপন করে সেখানে তরুণ শিক্ষানবিশদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই কলেজটি 'হেইলেবেরি কলেজ' নামেও পরিচিত।

• সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা: ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানির পরিচালকবর্গের সুপারিশ অনুসারে ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সন্তানরাই ভারতে প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদে নিযুক্ত হতেন। এ নিয়ে নানা অশুভ প্রতিযোগিতা চলত এবং অনেক সময় অযোগ্য ব্যাক্তিরা নিযুক্ত হতেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে (Charter Act of 1853) স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, ইংল্যান্ডে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসে কর্মচারী নিয়োগ করা হবে। ইংল্যান্ড রাজের যে-কোনো প্রজা এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারবে এবং পরীক্ষার্থীদের ব্যাস হবে ১৮ থেকে ২০-এর মধ্যে।


 গুরুত্ব: কালক্রমে 'ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একটি সুদক্ষ ও ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণিরূপে সংগঠিত হয়। এর সদস্যরা স্বাধীনচিত্ততা, সততা, দক্ষতা ও কঠোর পরিশ্রমের একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস-কে ব্রিটিশ শাসনের ইস্পাত- কাঠামো' ('Steel-frame") বলা হত। এর দ্বারা ভারতীয়দের অবশ্য কোনো উপকার হয়নি, কারণ তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থরক্ষা করা। এই কারণে ভারতের ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী শক্তির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যই ছিল এই আই. সি. এস. সম্প্রদায়।


সামরিক বাহিনী


© গুরুত্ব: ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ, অর্থাৎ মাত্র একশো বছরের মধ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতজয় সম্পন্ন করে। এ ব্যাপারে কোম্পানির সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম স্তম্ভ ছিল সিভিল সার্ভিস, আর দ্বিতীয় স্তম্ভ ছিল সামরিক বাহিনী। ড. স্পিয়ার বলেন যে, “সিভিল সার্ভিস গভর্নর জেনারেলের দক্ষিণ হস্ত হলে সেনাবাহিনী ছিল তাঁর বাম হস্ত" ("If the civil service was the right hand of the Governor General, the army was his left-The Oxford History of Modern India, P. 180)। সেনাবাহিনীর কাজ ছিল মূলত তিনটি—(১) ভারতীয় রাজ্যগুলি দখল, (২) বিদেশি আক্রমণ প্রতিরোধ এবং (৩) অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন।


ভারতীয় সেনার আধিক্য : কোম্পানির সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সেনাই সংগৃহীত হত বর্তমান বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির অধিকাংশ সেনাই ছিল। ভারতীয়। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা সবাই ছিল ইংরেজ। কর্নওয়ালিসের আমল থেকে কোনো ভারতীয়কে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিয়োগ করা হত না। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। সেনাবিভাগে মাসিক ৩০০ টাকার বেশি বেতন পেত, এমন ভারতীয়র সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন। একজন ভারতীয়র পক্ষে সর্বোচ্চ পদ ছিল সুবাদার এবং এর সংখ্যাও ছিল নগণ্য। সে যুগে ভারত জয়ের জন্য কোম্পানিকে ভারতীয় সেনাদলের ওপরেই নির্ভর করতে হয়েছিল, কারণ ওই সময় ভারতে ব্রিটিশ সেনাদল পোষণ ছিল খুবই ব্যয়সাধ্য। মুষ্টিমেয় ইংরেজ অধিকাংশ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনীর সাহায্যে, এদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার ও বজায় রাখতে পেরেছিল মূলত দুটি কারণে। (১) এদেশে এখনও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়নি। তাই এ দেশীয় সৈনিকরা ভাবতেই পারেনি যে ইংরেজদের সাহায্য করে তারা দেশদ্রোহিতা করছে। (২) যে বেতন দিত, ভারতীয় সৈনিক বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার পক্ষেই লড়াই করত। ইংরেজ প্রভুর ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।


পুলিশ


ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তৃতীয় স্তম্ভ ছিল পুলিশ বিভাগ (The third pillar of British rule was the police"Modern India, Dr. Bipan Chandra, P. 110.)। ড. স্পিয়ার বলেন যে, পুলিশ ছিল সেনাবাহিনীর সহকারী ("Subsidiary to the army was the police.") এবং পুলিশের প্রধান কাজ ছিল কোম্পানির বিজিত অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা। ভারতে অনেক কিছুর মতো এই বিভাগটিরও ষষ্টা ছিলেন কর্নওয়ালিস। তিনি জমিদারদের হাত থেকে পুলিশি দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে জেলাগুলিকে কয়েকটি থানায় ভাগ করেন। প্রত্যেক থানায় একজন করে ভারতীয় 'দারোগা' নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে সমগ্র জেলার পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ দায়িত্ব দেওয়া হয় সুপারিন্টেডেন্ট অব পুলিশ নামক কর্মচারীর ওপর। এই বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ-পদগুলিতে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হত না। গ্রামে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব ছিল চৌকিদারদের ওপর। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, খুন-রাহাজানি-ডাকাতি দমন প্রভৃতি কাজে সফলতা অর্জন করলেও সাধারণ ভারতীয়দের কাছে পুলিশের জনপ্রিয়তা ছিল না। সরকারি কর্তৃত্বের প্রতীক পুলিশবাহিনী জনমানসে স্বৈরাচার ও ঘৃণার প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়। বিচারব্যবস্থা


 বিবর্তন : কোম্পানির শাসনের সূচনাপর্বে দেশে পূর্বতন আইনকানুনই প্রচলিত ছিল, কিন্তু কালক্রমে ব্রিটিশ-রাজ ভারতে এক নতুন ধরনের বিচারব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যবস্থার সূচনা ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় 'সুপ্রিমকোর্ট' প্রতিষ্ঠিত হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস বিচারব্যবস্থাকে আরও সুসংগঠিত করেন। তাঁর আমলে সদর নিজামত আদালত' ও 'সদর দেওয়ানি আদালত' নামে দুটি সর্বোচ্চ আপিল আদালত ছিল। এই দুটি আদালতের বিচারভার অর্পিত ছিল সম্পূর্ণভাবে গভর্নর জেনারেলের হাতে। তিনি নরহত্যাকে 'রাষ্ট্রীয় অপরাধ' বলে ঘোষণা করেন এবং বেত্রদণ্ড, অাচ্ছেন প্রভৃতি অমানবিক দণ্ড তুলে দেন। লর্ড বেন্টিঙ্কের (১৮২৮-৩৫ খ্রি.) আমলে বিচারব্যবস্থা আরও উন্নত হয়। তিনি ভারতীয়দের বিচারক পদে নিয়োগ করে তাদের বেতন, ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তাঁর আমলে 'ভারতীয় দণ্ডবিধি' বা 'পেনাল কোড' রচনার উদ্যোগ শুরু হয়।


আইনের শাসন ভারতে 'আইনের শাসন' ('Rule of Law) প্রবর্তন ইংরেজ শাসনের বিশেষ কৃতিত্ব। এর মূল কথা—কেউই নিজের খেয়ালখুশিমতো চলতে পারবে না, সকলকে দেশের আইন মেনে চলতে হবে এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে এই ধারণা ভারতে অজ্ঞাত ছিল। এ ছাড়া, ব্রিটিশ শাসন ভারতে আইনের নিরপেক্ষতা' (Equality before Law) অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান—এই আদর্শ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। তবে, উচ্চ আদর্শের কথা ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। ভারতে ইওরোপীয়দের জন্য পৃথক আদালত ছিল, ভারতীয় বিচারকরা ইওরোপীয়দের বিচার করতে পারতেন না, ইওরোপীয় বনাম ভারতীয়দের বিচারে ভারতীয়রা ন্যায় বিচার পেত না। এবং বিচারব্যবস্থা বায়বহুল হওয়ায় দরিদ্ররা বর্ণিত হত। এ সত্ত্বেও একথা স্বীকার্য যে, একটি উচ্চ আদর্শের কথা ঘোষণা করে ইংরেজরা এদেশে বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়।

বৃত্তি


ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে নতুন সামাজিক শ্রেণি ও নতুন বৃত্তি বা পেশার উদ্ভব হয়। এগুলি ছিল এই আমলে প্রবর্তিত নতুন সামাজিক অর্থনীতি, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা, নতুন রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র এবং নতুন ধরনের শিক্ষাবিস্তারের প্রত্যক্ষ ফল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এইসব নতুন বৃত্তির উদ্ভবের প্রক্রিয়া অবশ্য সমান ছিল না। যে যে এলাকা আগে ব্রিটিশের প্রভাবাধীনে এসেছিল, সেইসব এলাকায় নতুন বৃত্তিগুলির উদ্ভব অপেক্ষাকৃত আগে হয়। বাংলাদেশেই প্রথম ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশেই প্রথম জমিদারি প্রথা, জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম হয় এবং জমিদার ও প্রজা নামক দুটি সামাজিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়। বাংলা ও বোম্বাইতে প্রথম সুতা ও চটকল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই দুটি স্থানেই প্রথম শিল্পপতি ও শ্রমিক নামে দুটি শ্রেণি বা বৃত্তির উদ্ভব ঘটে। কোম্পানির সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নতুন নতুন শহরের পত্তন হয় । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-জনিত কারণে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় জজ, আমলা, উকিল, কেরানি, মুহুরি, মোক্তার প্রভৃতি নতুন বৃত্তিজীবীর সংখ্যা। কোর্ট- কাছারিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বাসস্থান, রাস্তাঘাট, দোকান-পাট। প্রশাসনিক কারণেই শহরগুলিতে গড়ে ওঠে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা, আইন, বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতির শিক্ষাকেন্দ্র। এর ফলে শহরে ছোটো ব্যবসায়ী, দোকানদার, শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক সাংবাদিক প্রভৃতি নানা পেশাগত শ্রেণির আবির্ভাব হয়। এরাই হল ভারতীয় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শিল্পক্ষেত্রে আবির্ভূত হয় পুঁজিপতি শ্রেণি। গ্রাম ও শহরের এই বৃত্তিধারী মধ্যবিত্তরাই পরবর্তীকালে ভারত ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();