ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাসংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষা ও তার ফলাফল (Land Revenue Experiments and its Results) |দ্বৈত শাসন |পাচশালা ও একসালা বন্দোবস্ত|চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত| রায়তওয়ারি ব্যবস্থা|মহলওয়ারি ব্যবস্থা|
(1) দ্বৈত শাসন : ভারতে কৃষি-অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসন যে পরিবর্তন এনেছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভূমিরাজস্ব হিসেবে সমস্ত কৃষি উদ্বৃত্ত আদায় করা। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মোগল ব্যবস্থাই বজায় রাখে। মহম্মদ রেজা খাঁ ও সিতাব রায়ের ওপর যথাক্রমে বাংলা এবং বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়। প্রশাসনিক দায়িত্বভার থাকে নবাবের হাতে। এই শাসনব্যবস্থা 'দ্বৈত শাসন' নামে পরিচিত। এই ‘দ্বৈত শাসনের’ ফলাফল খুবই মারাত্মক হয়। 'আমিলদার' নামক দুর্নীতিগ্রস্ত রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচারে মানুষের দুর্দশা চরমে ওঠে। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে' বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়। © (ii) পাঁচসালা ও মালা বন্দোবস্ত। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানি গ্রহণ করে। রাজস্ব আদায়ের জন্য গভর্নর ও তাঁর কাউন্সিলের চারজন সদস্যকে নিয়ে একটি 'ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠিত হয় (১৪ই মে, ১৭৭২ খ্রি.)। এই কমিটি জেলায় জেলায় ঘুরে ইজারাদারদের নিলামে জমি বন্দোবস্ত দেয়। যে-ইজারাদার কোম্পানিকে সর্বোচ্চ কর দিতে রাজি হয়, তাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা ইজারাদারি ব্যবস্থা' বা 'পাঁচসালা বন্দোবস্ত (১৭৭২-৭৭ খ্রি.) নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় নানা অসুবিধা দেখা দেয়। এর ফলে হেস্টিংস ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে 'একসালা বন্দোবস্তু' চালু করেন। এই ব্যবস্থায় প্রতি বছর নিলামের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। প্রতি বছর নতুন নতুন জমিদার আসায় এই ব্যবস্থাও প্রজার পক্ষে মঙ্গলজনক হয়নি।
(iii) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আসেন। কোম্পানির কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাংলায় স্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ফেব্রুয়ারি বাংলা ও বিহারে এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যায় দশসালা বন্দোবস্ত ' প্রবর্তিত হয়। কোম্পানির পরিচালক সভার অনুমোদনক্রমে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২শে মার্চ দশসালা বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়। এই ব্যবস্থা অনুসারেই স্থির হয় যে, জমিদার-তালুকদাররা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের দেয় রাজস্ব সরকারকে প্রদান করে বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগ করতে পারবেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পশ্চাতে কোম্পানির বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য বা স্বার্থ ছিল, কিন্তু সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি।
(iv) রায়তওয়ারি ব্যবস্থা : অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে ইংরেজ শাসন সম্প্রসারিত হলে ওই অঞ্চলে কী ধরনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ইতিমধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ত্রুটিগুলি প্রকট হয়ে উঠতে থাকলে কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে মোহমুক্ত হন। আলেকজান্ডার রীড ও স্যার টমাস মনরো-র উদ্যোগে এই অঞ্চলে রায়তওয়ারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় (১৮২০ খ্রি.)। এই ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কৃষকরা সরাসরি সরকারকেই রাজস্ব দিত—কোনো জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে নয়। এই ব্যবস্থায় জমির ওপর কৃষকের মালিকানা-স্বত্ব ছিল না—ছিল জমি ভোগ করার স্বত্ব। রাজস্বের হার ছিল খুব উঁচু এবং সাধারণত ত্রিশ বছর অন্তর রাজস্বের হার পরিবর্তন করা হত।
(v) মহলওয়ারি ব্যবস্থা: গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে মহলওয়ারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় (১৮২২ খ্রি.)। এই প্রথা জমিদারি প্রথার অনুরূপ। এই প্রথা অনুসারে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি 'মহল' বা 'তালুক' সৃষ্টি করা হত এবং রাজস্ব দেওয়ার শর্তে কোনো একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তিকে যৌথভাবে ওই মহলের ইজারা দেওয়া হত। কিছুদিন অন্তর অন্তর ভূমিরাজস্ব পুনর্নির্ধারণ করা হত। এতে জমিদারের প্রাপ্য ছিল রাজস্বের মাত্র ২০% এবং সরকার পেত ৮০%।
© (nl) ভাইয়াচারি ব্যবস্থা : পাঞ্জাবে 'ভাইয়াচারি ব্যবস্থা' প্রবর্তিত হয়। এই ব্যবস্থা অনুসারে গ্রামের প্রত্যেক চাষির ওপর পৃথক পৃথকভাবে রাজস্ব ধার্য করা হত এবং এই রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব গ্রামেরই এক ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত হত। এই ব্যবস্থায় কয়েক বছর অন্তর রাজস্বের হার বৃদ্ধি করা হত।
• ফলাফল: ইংরেজ-সৃষ্ট নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাদি ভারতীয় সমাজ ও জনজীবনে ব্যাপক ও সুদুরপ্রসারী পরিবর্তন আনে। এর ফলে এদেশের চিরাচরিত ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এবং এক নতুন ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়।
(a) কৃষকদের দুর্দশা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রায়ত বা কৃষক সম্প্রদায়। জমিদার জমির মালিক এবং কৃষক ভাড়াটিয়া প্রজায় পরিণত হয়। জমিদার ইচ্ছা করলে যে-কোনো সময় প্রজাকে জমি থেকে উৎখাত করতে পারত এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য অত্যাচার করত। জমিদারের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে ১৭৯৩, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে পরপর কয়েকটি আইন পাস করা হয়। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল উৎপন্ন ফসলের ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ। শস্যহানি হলেও খাজনা দিতে হত। এ ছাড়া ছিল নানা অবৈধ কর, যেগুলি দেওয়ার সামর্থ্য কৃষকের ছিল না। সব ব্যবস্থাতেই কৃষকের অবস্থা ছিল সমান। পূর্বে ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব দেওয়ার পদ্ধতি চালু ছিল। ইংরেজ সরকার এই রীতি বাতিল করে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদানের রীতি চালু করে। এর ফলে প্রজারা ফসল বিক্রি করে সরকারকে রাজস্ব মেটাত। দুর্ভিক্ষ, অজন্মা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল না হলেও সরকারের প্রাপ্য তাদের মেটাতেই হত। এই অবস্থায় তারা ঋণ গ্রহণে বাধ্য হত এবং তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য গ্রামাঞ্চলে নতুন 'মহাজন' সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। তারা চড়া সুদে কৃষকদের ঋণ দিত। ঋণ শোধ করতে না পারলে ঋণগ্রস্ত কৃষকের জমি ও সম্পত্তি ক্রোক করা হত। এইভাবে ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা ভূমিহীন কৃষি-অনিকে পরিণত হয়। সুতরাং নতুন এইসব ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা কৃষকের জীবনে দারিদ্র্য ও শোষণই বৃদ্ধি করে।
(b) দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ:- কোম্পানির ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, আর্থিক নীতি এবং সরকার, জমিদার ও মহাজনদের শোষণে সাধারণ মানুষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। দারিদ্র দেশবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। এইসব অনাচারের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ ছিল ভারতে কোম্পানির আমলের প্রথম দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি ছিল মারাত্মক। এর পরেও ১৮০৩, ১৮০৪, ১৮০৭, ১৮২৩, ১৮৩৩, ১৮৩৭, ১৮৭৬-৭৮, ১৮৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক ধরনের বহু দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা জাতীয় জীবনে চরম সংকট ডেকে আনে।
No comments:
Post a Comment