ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রতিষ্ঠা : ১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি. (The Esta blishment of British Power in India : 1757-1857 AD) |পলাশীর যুদ্ধ |বক্সারের যুদ্ধ | প্রথম ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ| দ্বিতীয় ইঙ্গো মহীশূর যুদ্ধ| প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ |তৃতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ| - SM Textbook

Fresh Topics

Monday, September 18, 2023

ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রতিষ্ঠা : ১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি. (The Esta blishment of British Power in India : 1757-1857 AD) |পলাশীর যুদ্ধ |বক্সারের যুদ্ধ | প্রথম ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ| দ্বিতীয় ইঙ্গো মহীশূর যুদ্ধ| প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ |তৃতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ|

 ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রতিষ্ঠা : ১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি. (The Esta blishment of British Power in India : 1757-1857 AD) |পলাশীর যুদ্ধ |বক্সারের যুদ্ধ | প্রথম ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ| দ্বিতীয় ইঙ্গো মহীশূর যুদ্ধ| প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ |তৃতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ|





বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি ও ভারতের অমিত ঐশ্বর্যের আকর্ষণে খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় বণিকরা দলে দলে ভারতে আসতে থাকে। ভারতের নানা স্থানে তাদের বাণিজ্য- কুঠি নির্মিত হয়—এমনকি অনেকে দুর্গ নির্মাণ করে নিজ নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী। হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর পতনোন্মুখ মোগল রাজতন্ত্র এবং অকর্মণ্য প্রাদেশিক রাজন্যবর্গের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে এবং কালক্রমে ভারতে ইংরেজ বণিকদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


১৭৫৭-১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত


পলাশির যুদ্ধ : বাংলাদেশেই প্রথম ইংরেজ বণিকদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ (১৭১৭-২৭ খ্রি.), সুজাউদ্দিন খাঁ (১৭২৭- ৩৯ খ্রি.), আলিবর্দি খাঁ (১৭৪০-৫৬ খ্রি.) প্রমুখ ইংরেজ বণিকদের শক্তি সম্পর্কে সজাগ ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে বিরোধ এড়িয়ে চলতেন। সিরাজ-উদদৌলা (১৭৫৬-৫৭ খ্রি.) সিংহাসনে বসলে তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ শুরু হয়। ইংরেজ বণিকরা বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে চাইত। নবাবের নিষেধ সত্ত্বেও তারা বাংলায় দুর্গ নির্মাণ করত। এগুলি নবাবের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। নবাবের আত্মীয়রাও তাঁর বিরোধিতা করছিল। এ ছাড়া তরুণ নবাব সিরাজের আচার-আচরণে মুরশিদাবাদের রাজকর্মচারী ও শেঠ সম্প্রদায় প্রবল ক্ষুদ্র ছিলেন। তাঁরা এই উদ্ধত ও অপরিণামদর্শী নবাবকে সরিয়ে তাঁর সেনাপতি মিরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তাঁদের আহ্বানে ইংরেজ বণিকদের গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। স্থির হয় যে, মিরজাফর সিংহাসনে বসলে তিনি ইংরেজ কোম্পানিকে প্রচুর অর্থ ও বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা দেবেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন পলাশির প্রান্তরে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ পলাশির যুদ্ধ নামে খ্যাত এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাংলার রাজনীতিতে ইংরেজ কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, নতুন নবাব মিরজাফর সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির 'হাতের পুতুলে' পরিণত হন এবং বাংলাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।

মিরজাফর : কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপঢৌকন দিয়ে মিরজাফর (১৭৫৭-৬০) খ্রি.) বাংলার মসনদে বসেন। তিনি ছিলেন কোম্পানির 'হাতের পুতুল। এ সময় রাজ্যের সকল ক্ষমতা কোম্পানির হাতে চলে যায়। ইংরেজদের চাহিদামতো ক্রমাগত বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগাবার শক্তি না থাকায় কোম্পানি তাকে সরিয়ে তাঁর জামাতা মিরকাশিমকে বাংলার নবাব বলে ঘোষণা করে।


বক্সারের যুদ্ধ: মিরকাশিম ( ১৭৬০-৬৩ খ্রি.) ছিলেন স্বাধীনচেতা নবাব ইংরেজদের হাতের পুতুল নয়। সিংহাসনে বসে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিমতো সব প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে তিনি রাজ্যের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। এ সময় কোম্পানির কর্মচারীরা দত্তকের অপব্যবহার ক'রে বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করত। এতে নবাব ও দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত ইত। নবাব এ ব্যাপারে বারংবার প্রতিবাদ জানান, কিন্তু তাতে কোনো সুফল হয়নি। এই কারণে নবাব দেশীয় বণিকদের ওপর থেকেও বাণিজ্য শুল্ক তুলে দেন। এটা ইংরেজ বণিকদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এর ফলে দুপক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়। কাটোয়া, গিরিয়া ও উদয়নালা- পর পর তিনটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিরকাশিম অযোধ্যায় পলায়ন করেন। তারপর অযোধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলা ও দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের সলো মিলিত হয়ে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধে এই সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধ অপেক্ষা বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের যে প্রভুত্বলাভ হয়, বক্সারের যুদ্ধে তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বক্সারের যুদ্ধের ফলে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হন। বাংলার বুকে কোম্পানির যথেচ্ছ লুণ্ঠন শুরু হয় এবং অযোধ্যার নবাব কোম্পানির অনুগত মিত্র ও মোগল সম্রাট কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। এক কথায়, এর ফলে উত্তর ভারতে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান রচিত হয়।


 দেওয়ানি লাভ: মিরকাশিমের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি তাঁকে পদচ্যুত করে মিরজাফরকে (১৭৬৩-৬৫ খ্রি.) সিংহাসনে বসায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর নাবালক পুত্র নজম-উদদৌলা সিংহাসনে বসেন। কোম্পানির সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে তিনি কোম্পানির বৃত্তিভোগী পুতুলে পরিণত হন এবং তাঁর সকল সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তগত করে কোম্পানি বাংলার প্রকৃত শাসকে পরিণত হয়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দিল্লির 'নামেমাত্র' বাদশা, দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। স্থির হয় যে, এর বিনিময়ে কোম্পানি শাহ আলমকে কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ এবং বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা। দেবে। দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় বাহুবলের দ্বারা অর্জিত কোম্পানির অধিকার আইনানুগভাবে স্বীকৃত হয় এবং কোম্পানি বাংলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।


 ভেৱেলেস্ট— প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ: ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভেরেলেস্ট (১৭৬৭- ৬৯ খ্রি.) বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। এ সময় ভারতে মারাঠা ও মহীশূর রাজ্য ছিল। ইংরেজদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ভারতে ইংরেজ শক্তির সম্প্রসারণের পথে প্রধান অন্তরায়। এ সময় মহীশূরে হায়দার আলি (১৭৬১৮২ খ্রি.)-র উত্থান ঘটলে দাক্ষিণাত্যের অপর তিন শক্তি—ইংরেজ, মারাঠা ও হায়দ্রাবাদের নিজাম আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং হায়দারের বিরুদ্ধে তারা একটি শক্তিজোট গঠন করে (১৭৬৬ খ্রি.)। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৬৭-৬৯ খ্রি.) শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা হায়দার আলির সকো সন্দি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সখি মাদ্রাজের সন্ধি (১৭৬৯ খ্রি.) নামে পরিচিত। এই সন্ধি যারা দুপক্ষের মধ্যে সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি।


 ওয়ারেন হেস্টিংস- (a) দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ: ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-৮৫ খ্রি.) গভর্নর হয়ে ভারতে আসেন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা মহীশূরের অন্তর্গত ফরাসি বাণিজ্য কেন্দ্র মাহে দখল করলে হায়দার আলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ) (১৭৮০-৮৪ খ্রি.) শুরু হয়। যুদ্ধ চলাকালে হায়দার আলির মৃত্যু ঘটে (১৭৮২ খ্রি.), কিন্তু তাঁর বীর পুত্র টিপু সুলতান (১৭৮২-৯৯ খ্রি.) বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি দ্বারা দ্বিতীয় ইচ্ছা-মহীশূর যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি পরস্পরকে ফেরত দেন। ওয়ারেন হেস্টিংস এই সন্ধিকে 'অপমানজনক শান্তি' বলে অভিহিত করেন।


(b) প্রথম ইচ্ছা-মারাঠা যুদ্ধ: পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে (১৭৬১ খ্রি.) শোচনীয় পরাজয়ের পর মারাঠা শক্তি সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পেশোয়া মাধব রাও-এর আমলে (১৭৬২-৭২ খ্রি.) মারাঠারা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা নারায়ণ রাও সিংহাসনে বসলে তাঁর পিতৃব্য রঘুনাথ রাও নারায়ণ রাও-কে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। ক্ষুব্ধ মারাঠা নেতৃবৃন্দ রঘুনাথ রাও-কে সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করেন এবং মৃত নারায়ণ রাও-এর শিশুপুত্র মাধব রাও নারায়ণ-কে সিংহাসনে বসান। রঘুনাথ রাও তখন বোম্বাই-এর ইংরেজ কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হন এবং দুপক্ষে সুরাটের সন্ধি (১৭৭৫ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। রঘুনাথের পক্ষ নিয়ে ইংরেজ সেনাদল পুনায় ঢুকে পড়ে। এর ফলে প্রথম ইঙ্গ- মারাঠা যুদ্ধের সূচনা হয় (১৭৭৫ খ্রি.)। কয়েক বছর যুদ্ধ চলার পর ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে সলবই- এর সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধ বন্ধ হয়। সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা মাধব রাও নারায়ণকে 'পেশোয়া' বলে স্বীকার করে ও রঘুনাথ রাও-এর পক্ষ ত্যাগ করে। এ ছাড়া, তারা সলসেট, বেসিন ও বোম্বাই-সন্নিহিত কিছু স্থান লাভ করে।


লর্ড কর্নওয়ালিস – তৃতীয় ইলা-মহীশূর যুদ্ধ: লর্ড কর্নওয়ালিসের (১৭৮৬-৯৩ খ্রিঃ) আমলে ইঙ্গ-মহীশূর সম্পর্ক আবার তিক্ত হয়ে ওঠে। ইংরেজ ও মহীশূর—দুপক্ষই জানত যে, ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র। এজন্য দুপক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে টিপু ইংরেজদের মিত্ররাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়। নিজাম ও মারাঠারা ইংরেজ পক্ষে যোগদান করেন। দু-বছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর ত্রিশক্তি জোটের কাছে টিপু পরাজিত হন। তাঁর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অধিকৃত হয় এবং তিনি শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি (১৭৯২ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হন। এই সন্ধি দ্বারা (১) টিপু তাঁর রাজ্যের অর্ধাংশ ইংরেজদের ছেড়ে দেন। নিজাম, মারাঠা ও ইংরেজরা এই অংশটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। (২) টিপু ইংরেজদের ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হন। এই সন্ধির দ্বারা দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

 লর্ড ওয়েলেসলি – (a) চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ: লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৯৮- (১৮০৫ খ্রি.) ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী শাসক ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি ধতি নীতি নামে এক সাম্রাজ্যবাদী নীতি প্রবর্তন করেন। এতে বলা হয় যে, যে-সমস্ত দেশীয় রাজা এই নীতি মেনে নেবেন কোম্পানি তাঁদের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু কোম্পানির বিনা অনুমতিতে কোনো মুখ ঘোষণা বা শান্তি স্থাপন করা যাবে না। এইসব রাজ্যে একদল ইংরেজ সৈন্য থাকবে এবং তাদের বায় নির্বাহের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কিছু অংশ ইংরেজদের ছেড়ে দিতে হবে। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ছিল পরাধীনতার চুক্তিতে স্বাক্ষরের নামান্তর। দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্বলচিত্ত, নীতিহীন, তীর ও আত্মমর্যাদাহীন হায়দ্রাবাদের নিজাম সর্বপ্রথম এই দাসত্বের ভূক্তি পাই ছাক্ষর করেন (১৭১১ খ্রি.)। তারপর একে একে তারে, ভূপাল, উদয়পুর, মালব, কৃষ্ণগত, ঘোষপুর, কাটিং সুরটি এবং পেশোয়া এই নীতি মেনে নেয়। টিপু সুলতান এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে চতুর্থ ইজা-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯৯ খ্রিঃ) শুরু হয়। সদাশির ও মলতেরি-পর পর দুটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে টিপু তাঁর রাজধানী এরাপত্তমে আশ্রয় নেন। শত্রুপক্ষ রাজধানী অবরোধ করে এবং তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর মৃত্যুতে স্বাধীন। মহীশূর রাজ্যের পতন ঘটে এবং মহীশূরের একাংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে ইংরেজরা ভারতে তাদের এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে রক্ষা পায়।


(b) দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ: অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে মারাঠা রাজ্যে নানা ধরনের অন্তর্যন্ত দেখা দেয়। এ সময় ভোঁসলে, গাইকোয়াড়, হোলকার, সিন্ডিয়া প্রমুখ সামন্তপ্রভুরা কার্যত স্বাধীন হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে সর্বদাই অন্তদি চলত। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট কূটনীতিজ্ঞ নানা ফড়নবিশের মৃত্যুর পর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও জটিল আকার ধারণ করে। দুর্বলচিত্ত পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি এই অন্তর্থনে নানা সময় নানা পক্ষকে ইচ্ছন জোগাতেন। এতে দ্রুত হোলকার তাঁর রাজধানী পুনা আকমল করে তাঁকে সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। পরাজিত পেশোয়া তখন ইংরেজদের শরণাপন্ন হন এবং রাজ্য পুনরুদ্ধারের আশা ২৮০২ খ্রিস্টাব্দে বেসিনের সন্ধি দ্বারা অধীনতা- মুলত মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বেসিনের সন্ধি মারাঠা জাতির মর্যাদাকে ধুলায় লুণ্ঠিত করে। সিদিয়া ও ভোঁসলে এই সবি মানতে রাজি ছিলেন না। পেশোয়া বাজিরাও-ও মনেপ্রাণে এই সন্ধি মানতে পারেননি। তিনি সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেকে গোপনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করতে থাকেন। সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে কোম্পানির মিত্র নিজামের রাজ্য আক্রমণ করলে দ্বিতীয় ইলা-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০৩-০৫ খ্রি.) শুরু হয়। পর পর কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁরাও ইংরেজদের অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর ফলে উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও চম্বল উপত্যকার বিস্তীর্ণ স্থান ইংরেজদের অধিকারে আসে। বেসিনের সন্ধি ও দ্বিতীয় ইলা-মারাঠা যুদ্ধের পর ইংরেজ শক্তি কার্যত ভারতে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।


• লর্ড মিন্টো- ইলা-শিখ সম্পর্ক: লর্ড মিন্টো (১৮০৭-১৩ খ্রি.)-র শাসনকালে পাঞ্জাবের রণজিৎ সিং-এর অগ্রগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ ও রণজিৎ সিং-এর মধ্যে অমৃতসরের সখি (১৮০১ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে শতদ্রু নদী ব্রিটিশ ভারতের সীমানা বলে চিহ্নিত হয়।

লর্ড মাংরা লর্ড মারার শাসনকালে (১৮১৩-২৩ খ্রি.) (১) প্রথম ইলা-নেপাল যু (১৮১৪-১৬ খ্রি.) সংঘটিত হয়। দু-বছর যুদ্ধ চলার পর ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে সগৌলির মন্দি ভারা দুপক্ষে শান্তি স্যাপিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে আলমোড়া, নৈনিতাল, সিমলা, মুসৌরি, কুমায়ুন, গাড়োয়াল প্রভৃতি স্থানে ব্রিটিশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। (২) তাঁর আমলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল তৃতীয় মঠ । অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নিলেও ব্রিটিশ কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পেশোয়া, সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে সচেষ্ট ছিলেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ পেশোয়াকে অপমানজনক পুনার সখি স্বাক্ষরে বাধ্য করলে পেশোয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সিন্ধিয়া, ভোঁসলে, হোলকার প্রমুখ মারাঠা নেতৃবৃন্দ ও এই বিদ্রোহে যোগাদান করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা যুদ্ধে পরাজিত হন। পেশোয়া পদ লুণ্ড করে তাঁর রাজ কোম্পানির সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। হোলকার অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং ভোঁসলের রাজ্য ইংরেজ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। তৃতীয় ইলা-মারাঠা যুদ্ধে মারাঠা শক্তির পতন হয় এবং ইংরেজ শক্তি ভারতে অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। (৩) এ ছাড়া তাঁর আমলে ১৮১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উদয়পুর, যোধপুর, জয়পুর, কোটা, বুন্দি, প্রতাপগড় প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজপুত রাজ্য অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এইভাবে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


 ১৮১৮ সালের গুরুত্ব: ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাঞ্জাব ও সিন্ধু ব্যতীত প্রায়


ভারতের সকল উল্লেখযোগ্য রাজ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মারাঠাদের পতনের ফলে ইংরেজরা ভারতে অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। এই কারণে ড. স্পিয়ার (Dr. Spear) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দকে জলবিভাজিকা' ('Watershed') বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে “ঐ বৎসর থেকেই ভারতে স্থাপিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়" ["The year 1818 marks a watershed in the history of British India. In that year the British dominion in India became the British dominion of India"-Oxford History of Modern India (1740-1975), P. Spear, 1998, P. 225]। বলা বাহুল্য, এই বক্তব্য যথার্থ নয় কারণ শিখদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সংগ্রাম তখনও শুরু হয়নি। ১৮১৮-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত


১৮১৮ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ শক্তি বিস্তৃত হয়। সিন্ধু, পাঞ্জাব, অযোধ্যা, সমগ্র মধ্য ভারত ও প্রচুর ক্ষুদ্র রাজ্য এই সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভূক্ত হয়।


লর্ড আমহার্স্ট-প্রথম ইচ্ছা ব্রা যুদ্ধ : ব্রঘুরাজ বোদোপায়া (১৭৮২-১৮১৯ খ্রি.) ভারত সীমান্তে মণিপুর, আসাম, আরাকান প্রভৃতি স্থান দখল করেন। লর্ড আমহাস্টো শাসনকালে (১৮২৩-২৮ খ্রি.) ব্রহ্মরাজ বাগিদা (১৮১৯-৩৭ খ্রি.) সিলেট অধিকার করার চেষ্টা করলে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইলা-ব্রয় যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি ইয়ান্দাকুর সন্ধি (১৮২৬ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হন। ফলে আসাম, কাছাড়, জান্ডিয়া ও মণিপুর রাজ্যগুলি ব্রিটিশ প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে। আরাকান ও তেনাসেরিম ইংরেজদের হস্তগত হয়।


 লর্ড এলেনবরা : লর্ড এলেনবরার শাসনকালে (১৮৪২-৪৪ খ্রি.) ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুদেশ ইংরেজ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

লর্ড হার্ডিওপ্রথম ইল্লা-শিখ যুদ্ধ: লর্ড হার্ডিঞ্জের শাসনকালে (১৮৪৪-৪৮খ্রি.) সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রথম ইলা-শিখ যুদ্ধ। পাঞ্জাবের সুকারচুকিয়া "মিসল'-এর অধিপতি রণজিৎ সিং শতদ্রু নদীর উত্তরে এক বিশাল শিখরাজা গঠন করেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরের সন্ধিদ্বারা স্থির হয়েছিল যে, তিনি শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরে রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হবেন না। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর শিখরাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং 'খালসা নামে শিখ সেনাবাহিনী রাজ্যে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর শিখবাহিনী শতদ্রু অতিক্রম করে ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমণ করলে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয়। মুদকি, ফিরোজ শাহ, আলিওয়াল ও সেরাও-এর যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়। লাহোরের সন্ধি (১৮৪৬ খ্রি.) দ্বারা শিখরা প্রচুর ক্ষতিপূরণ-সহ কাশ্মীর ও জলন্ধর দোয়াব ইংরেজদের ছেড়ে দেয় ও নানা অপমানজনক শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।


লর্ড ডালহৌসি—দ্বিতীয় ইচ্চা-শিখ ও দ্বিতীয় ইচ্ছা ব্রক্ষ্ম যুদ্ধ : (১) স্বাধীনতা-প্রিয় শিখদের পক্ষে অপমানজনক লাহোরের সন্ধি মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। দু-বছরের মধ্যেই লর্ড ডালহৌসি-র শাসনকালে (১৮৪৮-৫৬ খ্রি.) দ্বিতীয় ইা-শিখ যুদ্ধ শুরু হয় (১৮৪৮ খ্রি.)। গুজরাটের যুদ্ধে (১৮৪৯ খ্রি.) শিখা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। সমগ্র পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন আফগানিস্তানের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। (২) ডালহৌসির আমলে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে দ্বিতীয় ইা-ব্রহ্ম যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র দক্ষিণ ব্রহ্ম ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসে। (৩) তিনি কুশাসনের অভিযোগে অযোধ্যা রাজ্যটি দখল করেন। এ ছাড়া, নিজামের কাছ থেকে তিনি বেরার প্রদেশটি দখল করেন। (৪) রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি স্বত্ববিলোপ নীতি' নামে এক নীতি প্রবর্তন করে বলেন যে, কোনো অপুত্রক ভারতীয় রাজার দত্তক গ্রহণ করা চলবে না এবং সেই রাজার মৃত্যুর পর তাঁর রাজা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে। এই নীতির দ্বারা তিনি সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর, উদয়পুর, তাঞ্জোর, ভগৎ, কর্ণটিক প্রভৃতি রাজ্য দখল করেন। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর দত্তক পুত্র নানা সাহেবকে পেশোয়া পদ ও ভাতা থেকে বর্ণিত করা হয়। ডালহৌসির এই উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলে ভারতীয় রাজাদের মনে ভীতির সম্বার হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে দায়ী করা যায়।

No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();