উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কৃষক বিদ্রোহসমূহ (Peasant Uprisings: in the Later Half of the 19th Century)| নিলবিদ্রোহ| দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ| মুন্ডা বিদ্রোহ|
সরকারের ঔপনিবেশিক রাজস্ব নীতি এবং জমিদার ও মহাজনশ্রেণির শোষণ ও অত্যাচার ভারতীয় কৃষকদের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের বহু পূর্ব থেকেই হৃতসর্বস্ব দরিদ্র কৃষক—এমনকি অরণ্য-সন্তান কোল, ভিল, সাঁওতালরাও সরকারি অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহগুলির মধ্যে সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ ও মুন্ডা বিদ্রোহ অতি গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে মাওতাল অভ্যুত্থান।
পূর্বাভাষ : ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ দমিত হওয়ার পর ভারতীয় জনজীবন থেকে সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার উদ্দেশ্যে 'সাঁওতাল পরগনা" নামে একটি পৃথক জেলার সৃষ্টি করা হয় এবং একজন ডেপুটি কমিশনারের ওপর এই জেলার শাসনভার অর্পিত হয়। অ্যাসলি ইডেন ছিলেন এই জেলার প্রথম ডেপুটি কমিশনার। পুলিশবাহিনী সরিয়ে নিয়ে এই অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয় মাঝি' বা মোড়লদের ওপর। গ্রামের মোড়ল গ্রামবাসীদের তদারকির দায়িত্ব ফিরে পায়।
অসন্তোষের কারণ:- এসব ব্যবস্থায় সাঁওতালদের অসন্তোষ প্রশমিত হয়নি। (১) সাঁওতালদের মূল সমস্যা ভূমি-সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের 'প্রজাস্বত্ব আইন' দ্বারা তারা জমির ওপর কোনো স্বত্ব পায়নি। (২) ছোটনাগপুর অঞ্চলের চিরাচরিত 'কাঠি' স্বত্ব বা জমিতে গ্রামসমাজের যৌথ-স্বত্ব ব্যবস্থা নাকচ করে ইংরেজ আইনানুসারে জমিতে ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এইসব আইন সাঁওতাল স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। (৩) সরকারি করেন তার আগের মতোই বহাল থাকে। সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। (৪) সাঁওতাল পরগনায় আবার বহিরাগত বা "দিকু'-দের আগমন শুরু হয়। (৫) খ্রিস্টান মিশনারিরা তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে। (৬) ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের পর সরকার বনাবলকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করে। সাঁওতালদের চিরাচরিত "জুম চাষ' পদ্ধতি বাতিল করে আধুনিক প্রথায় চাষের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এইসব অনাচারের প্রতিবাদে সাঁওতাল সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নিজেদের ধর্ম রক্ষা করতে এবং সরকারি ভূমিব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা এক প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৮৭১ থেকে ১৮৮২ পর্যন্ত পরিচালিত এই আন্দোলন 'খেরওয়ার আন্দোলন' নামে পরিচিত। সাঁওতালদের আদি নাম ছিল 'খেরওয়ার' এবং তা থেকেই তাদের আন্দোলনের এই নামকরণ হয়।
খেরওয়ার আন্দোলন: 'খেরওয়ার আন্দোলন' ছিল সাঁওতালদের পুরোনো ঐতিহ্যে ফেরার আন্দোলন। ১৮৫৫-র বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর সাঁওতাল-রাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সাঁওতালরা আবার নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়। সুতরাং এই আন্দোলন হল বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভৃতি। ভগীরথ মাঝি, যদু মাঝি, পীরু মাঝি এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তারা ভিরংক, টাঙ্গি, কুঠার ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে সরকারি অফিস ও জমিদারের কাছারির ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। সেনাপতি টমাস গর্ডন পাঁচ হাজার সেনা ও কামানের সাহায্যে বহু সাঁওতালকে নির্মমভাবে হত্যা করে এই আন্দোলন দমন করেন।
নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ)
ভূমিকা: ভারতে নীলচাষের ইতিহাস অতি প্রাচীন। সম্ভবত ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড ছিলেন ভারতের প্রথম নীলকর (১৭৭৭ খ্রি.) এবং ইংরেজ বণিক কার্ল ব্ল্যাম ভারতে সর্বপ্রথম নীলশিল্প গড়ে তোলেন। অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের প্রভূত অগ্রগতি ঘটে এবং এর ফলে ইংল্যান্ডে নীলের চাহিদা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যে নীল হয়ে ওঠে প্রধান দ্রব্য এবং কোম্পানির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে (১৭৮০-১৮০২ খ্রি.) নীল উৎপাদনে ভারত বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে। প্রথম দিকে নীলচাষে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার ছিল এবং নীলকর নামে ইংরেজ কর্মচারীদের হায্যে নীলচাষ করা হত। দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত এক বিশাল অঞ্চলে নীলচাষ হত এবং এই বাংলার নীলই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট।
নীলচাষের পদ্ধতি: নীলকর সাহেবরা মোটা টাকা দিয়ে জমিদারদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য জমি ভাড়া করে তাতে নীলচাষ শুরু করে। প্রথমে তারা ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে চাষ করাত। পরে তারা দেখল যে, চাষিকে দিয়ে তার নিজের জমিতে নীলচাষ করাতে পারলে। লাভের সম্ভাবনা বেশি। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যশোহর, নদিয়া, পাবনা, খুলনা, ঢাকা, ফরিদপুর নীলকুঠিতে ভরে যায়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বাংলায় নীলকুঠির সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। নীলকুঠি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নীলকররা অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী ছিল। নিরক্ষর দরিদ্র চাষিকে মাত্র দু টাকা অগ্রিম দাদন দিয়ে তার সর্বোৎকৃষ্ট জমিতে তারা তাকে নীলচাষে বাধ্য করাত। ছলে-বলে-কৌশলে নীলকর সাহেবরা এমন চুক্তিপত্র তৈরি করত যে, চাবি সারাজীবন তাদের ঋণের চক্রে বাঁধা পড়ে থাকত এবং পুরুষানুক্রমে এই ঋণ শোধ করা তাদের সাধ্যাতীত ছিল। উৎপন্ন নীলের জন্য কৃষকদের যে-মূল্য দেওয়া হত, তাতে উৎপাদনের খরচ উঠত না। এর ওপর আবার নীলের মাপ বা ওজনেও তাদের ঠকানো হত। জমিতে ধান, তামাক, কলাই প্রভৃতি শস্যের চাষ লাভজনক হলেও, তাদের ওইসব চাষ করার অধিকার ছিল না। এইভাবে ধানচাষ বন্ধ হওয়ায় চাষির ঘরে তীব্র অন্নাভাব দেখা দেয়।
নীলকরদের অত্যাচার : নীলচাষে বাধ্য করার জন্য বা উপযুক্ত নীল আদায়ের জন্য নীলকুঠির সাহেবরা দরিদ্র চাষির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাত। তারা চাষিদের প্রহার করত, হত্যা করত, গোরুবাছুর লুট করত, গৃহে ডাকাতি ও অগ্নিসংযোগ করত, জোর করে কুঠিতে আটকে রাখত—এমনকি তাদের স্ত্রী-কন্যাকে অপহরণ করে লাঞ্ছিত করতেও তারা পিছপা হত না। কেবল দরিদ্র কৃষকই নয় – গ্রামাঞ্চলের সম্পন্ন কৃষক, জমিদার বা সাধারণ মানুষ কেউই তাদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেত না এবং এসব কাজে তাদের প্রধান সাহায্যকারী ছিল নীলকুঠির দেশীয় কর্মচারী ও লাঠিয়ালরা। এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদে আদালতে গিয়েও কোনো ফল হত না, কারণ দেশের আইন নীলকরদের স্বার্থেই রচিত হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশরা ছিল তাদেরই সহযোগী —এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নীলকররা নিজেরাই ছিল বিচারক।
শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা: নীলচাষিদের ওপর এই অবর্ণনীয় নির্যাতনের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে দেশের শিক্ষিত সমাজ এগিয়ে আসে। নীলকরদের অত্যাচারের কথা সর্বপ্রথম ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে 'সমাচার চন্দ্রিকা' ও 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে অক্ষয়কুমার দত্ত 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক), গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মনোমোহন ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রমুখ নীলচাষিদের নানাভাবে সাহায্য করেন ও নীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত নীলদর্পণ' নাটক প্রকাশিত হয়। নীলকরদের অকথ্য অত্যাচারে সোনার বাংলা কীভাবে শ্মশানে পরিণত হয়েছে তারই মর্মন্তুদ চিত্র এই নাটকে পরিস্ফুট হয়েছে। বিশিষ্ট ভারতপ্রেমিক জেমস লঙ্-এর উদ্যোগে মাইকেল মধুসূদন দর এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। নীলকররা লঙ্ সাহেবের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা বুদ্ধ করে এবং বিচারে তাঁর এক মাস কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়।
নীলবিদ্রোহের সূচনা : ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে কৃল্পনগরের কাছে চৌগাছা গ্রামে বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমে বিদ্রোহের আগুন সমগ্র নদিয়া, যশোহর, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহি, খুলনা, মালদহ, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর, বারাসত বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র বাংলা বারুদের স্তূপে পরিণত হয়। প্রায় ষাট লক্ষ কৃষক সামান্য বর্শা, তরবারি, বাঁশের লাঠি ও ফল নিয়ে এই বিদ্রোহে শামিল হয়। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। প্রথম পর্যায়ে তারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের কথা জানিয়ে প্রতিকারের জন্য আবেদন জানায়। এতে ফল না হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা নীলচাষ বয়কট করে। তাদের বলপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করা হলে শুরু হয় সক্রিয় প্রতিরোধ। নদিয়ার চৌগাছা গ্রামের বিচরণ বিশ্বাস ও নিগম্বর বিশ্বাস নীলচাষের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে। বিদ্রোহী চাষি নীলকুঠি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দিত, পথেঘাটে নীলকরদের লাঞ্ছিত করত, তাদের দৈনন্দিন রসদের জোগান বন্ধ করে দিত এবং নীলের চারা নষ্ট করে দিত। নীল আন্দোলনের ব্যাপকতায় ভারতের বড়োলাটও বিশেষ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের তুলনায় নীল বিদ্রোহজনিত পরিস্থিতি তাঁর অধিকতর উৎকণ্ঠা কারণ হয়ে উঠেছিল।
বিদ্রোহ দমন: বিদ্রোহ দমনের জন্য সরকার উপদ্রুত অঞ্চলে পুলিশ ও মিলিটারি- এমনকি যশোহর ও নদিয়া জেলায় দুটি ছোটো রণতরি পাঠায়। এই সময় 'একাদশ আইন পাস | করে বলা হয় যে, নীলকরদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছে এমন কৃষক নীলচাষ না করলে তাকে বিঘা প্রতি দশ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ: কেবলমাত্র দরিদ্র কৃষকই নয়—সম্পন্ন কৃষক, জোতদার, ছোটো ছোটো জমিদার সকলেই এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ স্থানীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করে স্থানীয় অবস্থানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলে এই আন্দোলনকে প্রকৃত গণআন্দোলনের রূপদান করেছিল। বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দের মধ্যে নদিয়ার বিচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস, পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহের ফরাজি নেতা রফিক মণ্ডল, খুলনার কাদের মোল্লা, সুন্দরবন অঞ্চলের রহিমউল্লা, কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের মেঘাই সর্দার, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার এবং নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়, সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য, রানাঘাটের জমিদার গোপাল পালচৌধুরী, চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায় প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, মনোমোহন ঘোষ, জেম্স্ লঙ্ প্রমুখ ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তির নামও বিশেষভাবে। স্মরণীয়।
প্রকৃতি:- ড. চিত্তব্রত পালিত নীল বিদ্রোহকে বাঙালি জমিদারদের সঙ্গে নীলকরদে সংঘাত বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, গ্রাম-বাংলায় নীলকরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাঙালি জমিদারদের স্বার্থে আঘাত লাগে এবং তাদের নির্দেশেই কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। বলা বাহুল্য, এই মত অধিকাংশ পণ্ডিতই অগ্রাহ্য করেছেন। আসলে এই বিদ্রোহ হল প্রকৃত গণ আন্দোলন। বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট একে "লক্ষ লক্ষ লোকের তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ” বলেছেন। 'ক্যালকাটা রিভিউ' লিখেছে, “এটা একটা বিদ্রোহ—সমগ্ৰ দেশই এতে যোগ দিয়েছে।”
ফলাফল: নীল বিদ্রোহের ফলে (১) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে 'নীল কমিশন' গঠিত হয় এবং এর ফলে নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচার জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ে। কমিশন স্পষ্ট ভাষায় বলে যে, “নীলকরদের ব্যাবসা-পদ্ধতি পাপজনক, ক্ষতিকারক ও ভ্রমসংকুল।" ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের 'অষ্টম আইন দ্বারা নীলচুক্তি আইন' রদ করে বলা হয় যে, নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে খিদের ইচ্ছাধীন। পরে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদনের ফলে এদেশে নীলচাষ প্রায় উঠে যায়। (২) এই বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষে সাহায্য করে। নীলকরদের অত্যাচার, দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটকের প্রকাশ, লঙ্-এর কারাবাস, হরিশচন্দ্রের মৃত্যু জাতীয় চেতনাকে নানাভাবে সঞ্জীবিত করে। (৩) মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ার কি তাঁর 'The Blue Mutiny' গ্রন্থে বলেন যে, নীলকরদের পতনের ফলে নিম্নবঙ্গোর কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী এই মতের অসারতা প্রমাণ করেছেন।
গুৰুত্ব: ভারত-ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। (১) এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম কৃষক, জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। (২) এই আন্দোলনেই খ্রিস্টান মিশনারিরা সর্বপ্রথম নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে চাষিদের পক্ষ অবলম্বন করে। (৩) এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে স্বৈরাচার মাথা নত করতে বাধ্য। শিশিরকুমার ঘোষ লেখেন যে, "নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর এটাই ছিল বাংলার প্রথম বিপ্লব।” (৪) এল. নটরাজন বলেন যে, নীলচাষ করতে অস্বীকার করে বাংলার কৃষকরা ভারতে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। (৫) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, “বাংলাদেশ তার কৃষককুল সম্পর্কে গর্ববোধ করতে পারে শক্তি নেই, অর্থ নেই, রাজনৈতিক জ্ঞান নেই, তবুও বাংলার কৃষকেরা এমন একটি বিপ্লব সংগঠিত করেছে যাকে অন্য দেশের বিপ্লবের থেকে কি ব্যাপকতায়, কি গুরুত্বে কোনো দিক থেকে নিকৃষ্ট বলা চলে না।” অমৃতবাজার পত্রিকার মতে, “এই বিদ্রোহ অর্ধমৃত বাঙালির শিরায় স্বাধীনতার উয় শোণিত প্রবাহিত করে।”
দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ (১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ)
ভূমিকা: দাক্ষিণাত্যের বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে যে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল তাতে প্রত্যেক চাষির ওপর পৃথক পৃথকভাবে খাজনা ধার্য করা হয় এবং তা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামের 'প্যাটেল'বা মোড়লদের ওপর। সরকারের খাজনার হার এমনিতেই ছিল অত্যন্ত চড়া, যা মেটাবার সাধ্য দরিদ্র কৃষকদের ছিল না। এ ছাড়া, খাজনা আদায়কারী "প্যাটেল' বা মোড়লরা বিভিন্ন কৌশলে নানা উৎপীড়নের মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায় করে তা আত্মসাৎ করত। এইভাবে সরকার ও প্যাটেল—এই দুই শোষকের হাতে পড়ে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। খাজনা মেটাবার জন্য তারা সাউকার বা মহাজনদের কাছ থেকে আরও চড়া সুদে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হত। ঋণের জালে আবদ্ধ দরিদ্র চাষির পক্ষে কখনোই ঋণ শোধ করা সম্ভব হত না। এর ফলে তারা জমিজমা—এমনকি মা- বোনের ইজ্জত হারিয়ে সর্বস্বান্ত হত। এইসব অনাচারের প্রতিবাদে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দরিদ্র এবং অপেক্ষাকৃত সচ্ছল কৃষকরা সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। এই ঘটনা দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ'বা সাউকার-বিরোধী দাঙ্গা' নামে পরিচিত।
মহাজনদের শোষণ: দাক্ষিণাত্যের প্রায় সর্বত্রই অসংখ্য মহাজনি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিভিন্ন শহরে এইসব মহাজনদের প্রত্যেকেরই অন্তত একটি করে গদি বা অফিস ছিল। চাষিকে মহাজনরা টাকা, বীজধান ও খাদ্যশস্য ঋণ দিত। এজন্য চাষিকে মহাজনের কাছে তার জমি বা জন্য কোনো মূল্যবান সামগ্রী জামিন রাখতে হত তবে জমিই ছিল মহাজনের অধিকতর কাম্য। সুদের হার ছিল শতকরা ৩৫ থেকে ৬০ টাকা এবং তা বৃদ্ধি পেত চক্রবৃদ্ধিহারে অর্থাৎ মূল টাকার সঙ্গে সুদ যোগ হয়ে আসলে পরিণত হত। এইভাবে প্রত্যেক চাষিই ঋণের জালে আবদ্ধ হত এবং পর্বতপ্রমাণ এই ঋণের বোঝা থেকে তার মুক্তি ছিল সাধ্যাতীত।
বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক কারণ: ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দাক্ষিণাত্যে কৃষিপণ্যের মূল্য যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে তীব্র অনাবৃষ্টি এবং ১৮৬৭-৬৮ ও ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর অজম্মা দেখা দেয়। ১৮৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে কৃষিপণ্যের মুলা আরও হ্রাস পেলে কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। উপরন্তু এ সময়েই বোম্বাই | সরকার জমির খাজনা প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি করে দেয়। এই অবস্থায় চাষিদের পক্ষে এই খাজনা মেটানো বা মহাজনকে ঋণের সুদ দেওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না। আদালতের সাহায্য নিয়ে মহাজনরা চাষিদের জমি ও বাড়ি দখল করে নিতে লাগল। অপরপক্ষে, সরকারও চাষিদের জমিজমা নিলামে তুলে খাজনা আদায় করতে লাগল এবং মহাজনরাই এইসব জমি কিনতে লাগল। এই শোচনীয় অবস্থায় নিজেদের জীবন ও জীবিকা রক্ষার তাগিদে দরিদ্র কৃষকরা মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
বিদ্রোহের সূচনা: ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পুনা জেলার কারদে গ্রামে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। কারদে গ্রামের কালুরাম নামে জনৈক মাড়োয়ারি মহাজন আদালতের সাহায্যে ঋণের দায়ে আবদ্ধ বাবাসাহেব দেশমুখ নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির জমিজমা ও ঘরবাড়ি আত্মসাৎ করলে দরিদ্র কৃষকরা মহাজনের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট শুরু করে। প্রকৃত হিংসাশ্রয়ী ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মে পুনা জেলার গুজরাটি মহাজন- অধ্যুষিত সুপা গ্রামে। উন্মত্ত জনতা গুজরাটি মহাজনদের ঘরবাড়ি, দোকান, গদি ও গুদাম লুণ্ঠন করে এবং তাতে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে। অচিরেই এই আন্দোলন পুনা জেলার অন্যান্য গ্রাম এবং আহম্মদনগর, ইন্দাপুর ও পুরন্দর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হয়।
বিদ্রোহ দমন: পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং কৃষকদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও তাদের ব্যাপক গ্রেফতারের মাধ্যমে অবস্থা আয়ত্তে আনে। প্রায় ৬ হাজার কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দিয়েও উপদ্রুত অঞ্চলগুলিকে একেবারে শান্ত করা যায়নি। বিদ্রোহ দমনের দীর্ঘকাল পরেও বিভিন্ন অঞ্চলে মহাজনদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতন চলত।
বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য:- এই বিদ্রোহের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। (১) বিদ্রোহী কৃষকরা দোকান, গুদাম প্রভৃতি লুণ্ঠন করত, এগুলিতে অগ্নিসংযোগ করত, মহাজনদের ওপর নির্যাতন চালাত, কিন্তু সাধারণভাবে তাদের হত্যা করত না। (২) বিদ্রোহী কৃষকদের ছিল ঋণপত্র, জমির দলিল ও হিসাবের খাতার দিকে। তারা এগুলি ধ্বংস করতেই আগ্রহী ছিল। এই ব্যাপক বিদ্রোহে মাত্র পাঁচজন মহাজন বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়। ঋণপত্র ও দলিলগুলি চাষিদের হাতে অর্পণ করতে সম্মত না হওয়ায় বিদ্রোহী কৃষকরা তাদের হত্যা করে। (৩) কেবল দরিদ্র কৃষকরাই নয় ধনী কৃষক ও সমাজের নেতৃস্থানীয় কিছু মানুষ
মহাজনদের হাতে সর্বস্বান্ত হয়ে এই বিদ্রোহে যোগ দেয় এবং অধিক রক্তপাত থেকে তারাই কৃষকদের নিরস্ত করে। দাক্ষিণাত্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও কৃষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। এ ব্যাপারে 'পুনা সার্বজনিক সভা'র ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ফলাফল: (১) দাক্ষিণাত্যের এই মহাজন-বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ ইংরেজ সরকার ও মহাজন উভয়কেই সন্ত্রস্ত করে তোলে। বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণ্যতা দাঙ্গা কমিশন' (Deccan Riot Commission) নিয়োগ করে। (২) এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্য কৃষি সাহায্য আইন' (Deccan Agriculturists Relief Act) প্রবর্তিত হয়। এই আইনে ঋণের দায়ে চাষিকে কারারুদ্ধ করা নিষিদ্ধ হয় এবং আদালতকে ঋণগ্রস্ত কৃষক ও মহাজনদের মধ্যে লেনদেন-সংক্রান্ত সব হিসাব পরীক্ষার অধিকার দেওয়া হয়। (৩) বলা বাহুল্য, মাত্র কয়েক বছরই এই আইন কার্যকরী ছিল। আইনজীবীরা ক্রমশ এই আইনের ধারাগুলি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেন।
মুণ্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ)
ভূমিকা: ভারতের আদিমতম আদিবাসী মুন্ডারা ছোটনাগপুর ও সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করত। ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তারা বীরসা মুন্ডা-র নেতৃত্বে এক ব্যাপক অভ্যুত্থানে শামিল হয়। এই ঘটনা ‘উলঘুলান' বা 'ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা' নামে পরিচিত।
কারণ: এই বিদ্রোহের পশ্চাতে বেশ কিছু কারণ ছিল। (১) মুন্ডাদের কৃষিব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ছিল 'মুকাঠি' প্রথা বা 'জমির যৌথ মালিকানা'। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার মুন্ডাদের এই চিরাচরিত ব্যবস্থায় ভাঙন ধরে এবং জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। (২) ছোটনাগপুর অঞ্চলে বাইরের ঠিকাদার, মহাজন ও জমিদারদের আগমন ঘটে এবং বহু জনিজায়গা তাদের অধীনে চলে যায়। (৩) মুন্ডাদের চিরাচরিত আইন, বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক বিধি বাতিল করে নতুন আইনকানুন প্রবর্তিত হয়। নগদে খাজনা দেওয়ার রীতি চালু হয়। খাজনা দিতে না পারলে তাদের জমি থেকে উৎখাত করা হত। (৪) জমিদার ও মহাজনরা তাদের ওপর নানা ধরনের ও বিশাল পরিমাণ করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। এর ছিল 'বেট বেগারি' প্রথা অর্থাৎ বিনা মজুরিতে মুন্ডাদের নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য করা হত। (৫) নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্বপ্ন মজুরির বিনিময়ে তাদের আসামের চা-বাগানে কুলির কাজে পাঠানো হত। সেখানে তারা মালিকদের অত্যাচারের শিকার হত। (৬) বহিরাগত মহাজনরা গ্রামে গ্রামে মদের দোকান খুলে তাদের নেশায় প্রলুদ্ধ করত এবং নেশাগ্রত অবস্থায়। দেনার দায়ে তাদের জমিজায়গা লিখিয়ে নিত। এ ছাড়া, (৭) লুথারান ও অ্যাশলিকান মিশনারিরা মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাদের চিরাচরিত ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচার চালাতে থাকে। এর ফলে মুক্তা সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
বীরসা মুন্ডার নেতৃত্ব: এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে মুন্ডারা বহু আগে থেকেই সংঘবদ হচ্ছিল। এ ব্যাপারে তারা সরকারের কাছে বহুবার আবেদন জানায়—এমনকি মহারানি। ভিক্টোরিয়ার কাছেও আর্জি জানানো হয়। এইসব আবেদন বা আর্জিতে কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে তারা এক স্বাধীন ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৮৭৪) জেলা উপহার গ্রামে এক ভাগচাদি পরিবারে বীরসা মুজার জন্ম। সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা সমাপ্ত করে দশ-বারো বছর বয়সে তিনি চাইবাসায় জার্মান মিশনারি পরিচালিত আপার প্রাইমারি বিদ্যালয়ে ভরতি হন এবং খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অচিরেই মিশনারিদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং তিনি মিশন থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে তিনি খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে নিজ ধর্মমতে ফিরে আসেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেয়েছেন বলে দাবি করেন এবং এক নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করেন। তিনি নিজেকে ঐশী শক্তির অধিকারী 'ধরতি আবা' বা 'ধরণীর পিতা' বলে ঘোষণা করেন। "সিং বোঙা' বা 'সূর্য দেবতা ছিলেন তাঁর উপাস্য দেবতা। তাঁর ধর্মের মূল কথা হল আত্মশুদ্ধি, ভালোবাসা ও সমবেত প্রার্থনা। অচিরেই তাঁর জনপ্রিয়তা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায় এবং মুন্ডাদের চোখে তিনি স্বয়ং ভগবানে রূপান্তরিত হন। তিনি প্রচার করতে থাকেন যে, তাঁর লক্ষ্য হল স্বাধীন মুন্ডা-রাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশিদের বহিষ্কার ও খাজনা বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, বিদেশিদের বহিষ্কার না করলে স্বাধীন ধর্মাচরণ সম্ভব নয়।
বিদ্রোহের সূচনা : এরপর বীরসা মুন্ডা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে মেতে ওঠেন এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে মুন্ডাদের সংগঠিত করেন। ৬০০০ মুন্ডাকে নিয়ে এক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। বিশ্বস্ত অনুচর গয়া মুন্ডা সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খুঁটি ছিল তাঁর প্রধান কেন্দ্র। এ ছাড়া রাঁচি, চক্রধরপুর, বুন্দু, তামার, তোর পা, কারা, বাসিয়া প্রভৃতি স্থানে গোপন খাঁটি নির্মিত হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর বিদ্রোহের দিন ধার্য হয়। রাঁচি ও সিংভূম জেলার গির্জা, থানা, সরকারি অফিস, জমিদার, মহাজন, পুলিশ ও ইংরেজ কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। ৯ই জানুয়ারি সইল রাকার পাহাড়ের যুদ্ধে মুন্ডাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। কয়েকশো বিদ্রোহী মুক্তা যুদ্ধে প্রাণ হারায়। অনেকে বন্দি হয়। বিচারে তাদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বীরসা মুণ্ডা বন্দি হন এবং ৯ই জুন মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। রাঁচি জেলে কলেরা রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। এইভাবে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ফলাফল ও গুরুত্ব : এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। (১) এই বিদ্রোহের পর সরকার মুন্ডাদের অভাব-অভিযোগ নিরসনে সচেষ্ট হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে *ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন' পাস করে মুন্ডাদের 'খুঁৎকাঠি' প্রথা স্বীকার করে নেওয়া হয়। তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ ও বেগারপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। (২) মূলত কৃষক বিদ্রোহ হলেও এর কর্মসূচি ও তাৎপর্য ছিল রাজনৈতিক। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন 'মুন্ডা-রাজ' প্রতিষ্ঠা। ব্যর্থ ও এই বিদ্রোহ মুন্ডাদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক চেতনা এবং মর্যাদাবোধ আনতে সক্ষম ) ব্যর্থতা সত্ত্বেও বীরসা মুন্ডা তাঁর অনুরাগীদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য অর্জন করেন। পরে মুন্ডাদের মধ্যে বীরসা সম্প্রদায়' ('Birsaite') নামে এক উপজাতি শাখা আত্মপ্রকাশ করে এবং তিনি বীরসা ভগবান' বলে পুজিত হতে থাকেন।
No comments:
Post a Comment