১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী বিদ্রোহসমূহ ( Pre-1857 Revolts and Civil Uprisings) ||সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ | রংপুর বিদ্রোহ কোল বিদ্রোহ| ফরাজী আন্দোলন| ওয়াহাবি আন্দোলন |সাঁওতাল বিদ্রোহ | - SM Textbook

Fresh Topics

Tuesday, September 19, 2023

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী বিদ্রোহসমূহ ( Pre-1857 Revolts and Civil Uprisings) ||সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ | রংপুর বিদ্রোহ কোল বিদ্রোহ| ফরাজী আন্দোলন| ওয়াহাবি আন্দোলন |সাঁওতাল বিদ্রোহ |

 ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী বিদ্রোহসমূহ ( Pre-1857 Revolts and Civil Uprisings) ||সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ | রংপুর বিদ্রোহ কোল বিদ্রোহ| ফরাজী আন্দোলন| ওয়াহাবি আন্দোলন |সাঁওতাল বিদ্রোহ |





সূচনা


১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে একের পর এক ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত হয়, যাতে দেশের কৃষক, তাঁতি, কারিগর, শিল্পী প্রভৃতি সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে।


বিদ্রোহের কারণ


(১) ভারতে আধিপত্য স্থাপনে ইংরেজদের মূল লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদী বাণিজ্যিক স্বার্থ। এই উদ্দেশ্য নিয়েই ভারতে তাদের সকল কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। (২) কোম্পানির সরকার প্রবর্তিত নতুন রাজস্ব নীতি ও ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, চিরাচরিত বিচারব্যবস্থার স্থলে নতুন বিচারব্যবস্থা ও আইনকানুন প্রবর্তন এবং ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ভারত- বাসীর মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। (৩) ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই ব্যবস্থার ফলে পুরোনো জমিদারদের জায়গায় বহু নতুন জমিদারের আবির্ভাব হয়, যারা প্রজাপীড়নের মাধ্যমে অধিক রাজস্ব আদায়ে তৎপর ছিল। এসময় গ্রামীণ সমাজে মহাজনশ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। তাদের কাছ থেকে গরিব প্রজারা চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হত এবং এর ফলে ঋণগ্রস্ত প্রজাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ত। (৪) রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কোম্পানি নিজেই ছিল জমিদার। রাজস্ব আদায়কারীরা অধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রজাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত এবং তাদের জমি থেকে উৎখাত করত। সরকারি নীতির ফলে ভারতের কৃষককুল ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। (৫) শুধু তাই নয়—শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনের কলকারখানায় ব্যাপক হারে ভোগ্যপণ্য উৎপাদিত হতে থাকে। এইসব পণ্যের বাজার ছিল উপনিবেশ ভারতবর্ষ। ভারতীয় পণ্যের ওপর উচ্চ করভার চাপিয়ে সরকার কৌশলে ভারতীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে থাকে। ভারতের চিরাচরিত ও সমৃদ্ধিশালী কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংস হয়। বেকার কৃষক এবং শিল্পীদের জীবনে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। তারা বিদ্রোহে শামিল হয়। সারা অষ্টাদশ ও উনিশ শতক ধরে ভারতের ব্যাপক স্থান জুড়ে একের পর এক বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ ছিল এইসব বিদ্রোহের একটি সম্মিলিত রূপ।


সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০ খ্রি.)


স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসন, শোষণ ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে বাংলার কৃষক সম্প্রদায়। এই আন্দোলন 'সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত—মোট চল্লিশ বছর। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাতে শুরু হলেও অচিরেই তা দাবানলের মতো বগুড়া, মালদহ, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কোচবিহার প্রভৃতি জেলায় সম্প্রসারিত হয়। এই বিদ্রোহের নায়কদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানি, মজনু শাহ, চিরাগ আলি, মুসা শাহ প্রমুখ। মোগল যুগের মধ্য ও শেষ ভাগে ভারতের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় বাংলা-বিহারের নানা অংশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেও তারা সন্ন্যাসী ও ফকিরের পোশাকই ব্যবহার করত। কোম্পানির স্বৈরাচারী নীতি তাদের বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয় এবং তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলার অত্যাচারিত কৃষক সম্প্রদায় ও মোগল বাহিনীর কর্মচ্যুত সেনারা। বিদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার। তাদের কার্যকলাপ উত্তরবঙ্গ ও বিহারে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বিদ্রোহীরা কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব দপ্তর, ধনী জমিদারদের কাছারি ও শস্যভাণ্ডার আক্রমণ করত— সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাদের কোনো আক্রমণ পরিচালিত হয়নি। এই ভয়াবহ বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনী নামে। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয় এবং এ জন্য নেতাদের অভিজ্ঞতার অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদের কথা বলা হয়। বড়োলাট ওয়ারেন হেস্টিংস এই বিদ্রোহকে 'হিন্দুস্থানের যাযাবর' ও 'পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব' বলে চিহ্নিত করলেও, এটি ছিল "প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ'। উইলিয়াম হান্টার, এডওয়ার্ড ও গ্যারাট একে কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন।


রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.)


১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরের কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বাংলা তথা ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পশ্চিম ভারতের এই ভাগ্যান্বেষী বণিক দেবী সিংহ রংপুরের ইজারাদার নিযুক্ত হয়ে জমিদার ও প্রজাদের ওপর অবিশ্বাস্য হারে কর ধার্য করেন, যা দেওয়ার ক্ষমতা কারও ছিল না। কর দিতে অসমর্থ প্রজা ও জমিদারদের ওপর নানা অত্যাচার চলত। তিনি ছোটোবড়ো বহু জমিদারকে উচ্ছেদ করেন। এই অবস্থায় ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি রংপুরের কয়েক হাজার কৃষক জনৈক নুরুলউদ্দিনের নেতৃত্বে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হিন্দু- মুসলিম কৃষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে রংপুরের সব জায়গা থেকে দেবী সিংহের রাজস্ব কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। বিদ্রোহ অচিরেই দিনাজপুর ও কোচবিহারে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। উপদ্রুত অঞ্চলে সেনাবাহিনী নামে। শেষ পর্যন্ত, নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ দমিত হয় (মার্চ, ১৭৮৩ খ্রি.)। এটি ছিল হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের মিলিত বিদ্রোহ। এর নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন গ্রামের শত শত কৃষক নেতা। তাঁদের নেতৃত্বে প্রায় এক লক্ষ কৃষক সম্মিলিত হয়।


কোল বিদ্রোহ (১৮২০ - ১৮৩৩ খ্রি.)


ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী কোলরা হো, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। এই অঞ্চলে তারা স্বাধীনভাবেই বসবাস করত। (১) ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে পোড়হাটের রাজা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করেন ও বিপুল পরিমাণে বার্ষিক করদানে সম্মত হন। তিনি পার্শ্ববর্তী কোল অঞ্চলটি নিজ রাজ্যাংশ বলে দাবি করেন এবং ইংরেজ সরকারও তা মেনে নেন। অতঃপর তিনি কোলদের 'হো' সম্প্রদায়ের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে গেলে কোলদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা রাজকর্মচারীদের হত্যা করে। তির-ধনুক- বল্লমে সজ্জিত আদিবাসী কোলরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত অরণ্য-সন্তান কোলরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় (১৮২১ খ্রি.)। (২) ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় কোলরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। রাজস্ব আদায়ের জন্য ছোটনাগপুর অঞ্চল হিন্দু, মুসলিম ও শিখ মহাজনদের ইজারা দেওয়া হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য তাদের অত্যাচার সীমা অতিক্রম করে। এই শোষণ ও উৎপীড়নের প্রতিবাদে বুন্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি ও সুই মুন্ডা কোলদের সমবেত করতে থাকে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে রাঁচি জেলায় মুন্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের কৃষকেরা সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ ও পালামৌ জেলার সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়। জমিদার, জোতদার, শস্যব্যবসায়ী, মহাজন, ইংরেজ কর্মচারী—এমনকি আদিবাসী নয়, এমন কোনো মানুষই বিদ্রোহীদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। দু-বছর চেষ্টার পর হাজার হাজার আদিবাসী নরনারী ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করেন। ফরাজি আন্দোলন (১৮১৮-১৯০৬ খ্রি.)বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার মুসলিম সমাজের ওপর এই আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের এই আন্দোলনের মূলশক্তি ছিল দরিদ্র কৃষিজীবী মুসলিমরা।


 প্রবর্তক শরিয়তউল্লাহ: এই আন্দোলনের প্রবর্তক মৌলবি হাজি শরিয়তউল্লাহ ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা, মক্কা ও কায়রোয় দীর্ঘকাল কোরান ও ইসলামি ধর্মতত্ত্বের পাঠ গ্রহণ করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে ‘ফরাজি' নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধর্মসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।


 আদর্শ : আরবি ভাষায় 'ফরাজি' কথার অর্থ হল "ইসলাম-নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য'। শরিয়তউল্লাহ ঘোষণা করেন যে, ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে ইসলাম-বিরোধী নানা কুসংস্কার ও দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোরানের নির্দেশ যথার্থভাবে পালন করে তিনি ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধনের কথা বলেন। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও অচিরেই এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে তিনি 'দার-উল- হারব” বা “শত্রুর দেশ' হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন যে, এই দেশ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বাসের যোগ্য নয়। তিনি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন এবং অচিরেই বরিশাল, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও ফরিদপুরের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মুসলিম চাষি, কারিগ বেকার তাঁতি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এইভাবে বাংলার কৃষকদের মধ্যে এক জাগরণের সৃষ্টি হয় এবং তারা জমিদারের অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সাহসী হয়।। © দুদুমিঞা: ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে শরিয়তউল্লাহ র মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহম্মদ মুসিন বা দুদুমিঞা (১৮১৯-৬২ খ্রি.) আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দক্ষ সংগঠক রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তিনি ঘোষণা করেন যে, জমির মালিক আল্লাহ্। সুতরাং জমিদারের খাজনা আদায়ের কোনো অধিকার নেই। তিনি তাঁর সমর্থকদের জমিদারের খাজনা না-দেওয়ার, নীলকরদের নীল চাষ না-করার এবং বিদেশি ইংরেজদের না মানার আহ্বান জানান। নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষক তাঁর নেতৃত্বে সমবেত হয়। দুদুমিঞার প্রধান কার্যালয় ছিল বাহাদুরপুরে। তিনি একটি সুদক্ষ গুপ্তচর বাহিনী ও দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। সমকালীন পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার এবং তারা তাঁর নির্দেশে যে-কোনো কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। অনুগামীদের নিয়ে তিনি অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের কাছারি ও কুঠিতে আক্রমণ চালাতেন।


 আন্দোলনের বিস্তার: ক্রমে এই আন্দোলন ফরিদপুর ও ঢাকা থেকে বাখরগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ব্যাপক অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। দুদুমিঞার কার্যকলাপে বিচলিত হয়ে নীলকর ও জমিদাররা তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। সরকারও তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত চারবার তাঁকে বন্দি করা হয়, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষি দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি বলে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়ামিঞা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজ ও জমিদার-বিরোধী কর্মসূচির পরিবর্তে ধর্ম- সংস্কারের দিকে নজর দেন। এর ফলে এই আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।


 গুরুত্ব: অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, ফরাজি আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় ভাব যুক্ত হলেও মূলত তা ছিল একটি কৃষক আন্দোলন। জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা প্রচার করে দুদুমিঞা কৃষকদের নতুন চেতনায় উদ্‌বুদ্ধ করেছিলেন। কেবল মুসলিমরাই নয়, হিন্দু কৃষকরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব, হিন্দু-বিরোধী মনোভাব, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, বলপূর্বক সাধারণ মানুষকে দলভুক্ত করা, অর্থ আদায় করা এবং যথার্থ নেতৃত্বের অভাবে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।


ওয়াহাবি আন্দোলন (১৮২৩-১৮৮৫ খ্রি.)


উদ্দেশ্য: 'ওয়াহাবি' আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল 'তারিখ-ই-মহম্মদীয়া', অর্থাৎ "মহম্মদ-প্রদর্শিত পথ'। অষ্টাদশ শতকে আবদুল ওয়াহাৰ (১৭০৩-৮৭ খ্রি.) নামে জনৈক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে প্রচলিত কুসংস্কারগুলি দূর করে মহম্মদ-প্রদর্শিত পথে ইসলাম ধর্মকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম-সম্প্রদায় 'ওয়াহাবি' এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মমত ওয়াহাবিবাদ' নামে পরিচিত। 'ওয়াহাবি' কথার অর্থ হল নবজাগরণ। ভারতে এই আন্দোলনের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। ইসলামধর্ম ও সমাজকে সকল কলুষতা থেকে মুগ্ধ করে কোরানের যথার্থ নির্দেশ অনুযায়ী ধর্ম ও সমাজকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দিল্লির বিখ্যাত মুসলিম সন্তু শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩- ৮৭ খ্রি.) ও তাঁর পুত্র আজিজ এই সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। সুতরাং সূচনাপর্বে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আন্দোলন এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ।


 সৈয়দ আহমদ : শাহ ওয়ালিউল্লাহ এই আন্দোলনের সূচনা করলেও ভারতে এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিণীর অধিবাসী সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.)। তিনি দিল্লিতে শাহ ওয়ালিউল্লাহের পুত্র আজিজের সংস্পর্শে আসেন এবং ১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের কথা প্রচার করতে শুরু করেন। এরপর তিনি মক্কায় যান এবং সেখানে ওয়াহাবি মতাদর্শের সঙ্গে সুপরিচিত হন। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসে তিনি ওয়াহাবি আদর্শে ভারতে শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। অনেকে বলেন যে, আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের সঙ্গে সৈয়দ আহমদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এবং ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল নীতিগুলির উদ্ভাবক ছিলেন তিনি নিজেই।


 সৈয়দ আহমদের মতবাদ : ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে ফিরে এসে তিনি কিছুকাল পাটনায় অবস্থান করেন। তাঁর ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে বহু মুসলিম তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। ক্রমে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং তাঁর ধর্মসংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। ফরাজি আন্দোলনের নেতা শরিয়তউল্লাহ-র মতোই তিনি ইংরেজ অধিকৃত ভারতকে দার-উল-হারব' বা 'শত্রুর দেশ' হিসেবে অভিহিত করেন এবং তাঁর অনুগামীদের 'ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের আহ্বান জানান। ইংরেজ'বণিক'-দের তিনি ভারতীয় স্বাধীনতার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিতাড়িত করার নির্দেশ দেন। আসন্ন ধর্মযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি এক সেনাদল গড়ে তোলেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সিতানায় মূলকেন্দ্র স্থাপন করেন। মূলত ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন হলেও ওয়াহাবিরা পাঞ্জাবের শিখদের সঙ্গে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। শিখদের বিরুদ্ধে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ পরাজিত হন ও প্রাণ হারান (১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে)।


 আন্দোলনের প্রসার: সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর পর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, বাংলা, বিহার, মিরাট, হায়দ্রাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চলে ওয়াহাবি বিদ্রোহ ব্যাপক রূপ ধারণ করে। ইংরেজদের পাঞ্জাব জয়ের পর (১৮৪৯ খ্রি.) ওয়াহাবিদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের সূচনা হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওয়াহাবি ধর্মযোদ্ধারা প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে মুলতানে সমবেত হয়। ১৮৫০ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সিতানা ঘাঁটি দখলের জন্য। ষোলো বার আক্রমণ চালিয়ে এবং এই অঞ্চলে ৩৫ হাজার সৈন্য নিয়োগ করেও ওয়াহাবিদের দমন করা সম্ভব হয়নি। শেষপর্যন্ত ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমিত হয়।


 তিরুমীর : বাংলাদেশে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১ খ্রি.)। তিনি চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্ভুক্ত হায়দারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মক্কায় হজ করতে গিয়ে তিনি সৈয়দ আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন ও ওয়াহাবি আদর্শ গ্রহণ করেন। অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী তিতুমীর সুদখোর মহাজন, নীলকর ও জমিদারদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে এক বিরটি সংগঠন গড়ে তোলেন। নির্যাতিত বহু হিন্দুও তাঁর সংগঠনে যোগ দেয়। চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, রাজশাহি, ঢাকা, মালদহ প্রভৃতি স্থানে তিনি তাঁর আন্দোলন শুধু করেন। জমিদার, নীলকর ও সরকার তাঁর বিরুদ্ধে সমবেত হয়। তারা একযোগে ওয়াহাবিদের ওপর নানা রকম অত্যাচার করতে থাকে। তিতুমীর বারাসত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘোষণা করে নিজেকে 'বাদশাহ' বলে অভিহিত করেন। বাদুড়িয়ার দশ কিলোমিটার দূরে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিনি একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। তিনি টাকি, গোবরডাঙা প্রভৃতি স্থানের জমিদারদের কাছ থেকে কর নবি করতে শুরু করেন। এই ঘটনা বারাসত বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। স্থানীয় জমিদারবর্গ, নীলকর এবং কোম্পানির পক্ষে এসব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁদের সম্মিলিত বাহিনী তিতুমীরের কাছে পরাজিত হয়। অতঃপর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম | বেন্টিঙ্ক তাঁর বিরুদ্ধে এক অভিযান প্রেরণ করেন। কামানের আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়। তিতুমীর ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন (১৯শে নভেম্বর)।


 ওয়াহাবি আন্দোলনের চরিত্র: ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি বা চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, বহু হিন্দু এই আন্দোলনের সমর্থক হলেও তা কখনোই জাতীয় আন্দোলন ছিল না বা এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতামুক্তও ছিল। না—হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সমান অধিকারের লক্ষ্য নিয়েও এই আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনের স্থলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ড. কুয়েমুদ্দিন আহমদ তাঁর 'দি ওয়াহাবি মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া' গ্রন্থে বলেন যে, এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম একত্রে অংশগ্রহণ করে এবং এতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ভূমিকা ছিল না। তাঁর মতে, এই আন্দোলন ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্য এবং আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে ব্রিটিশ শক্তির বিতাড়ন। ড. শশীভূষণ চৌধুরির মতে ওই আন্দোলন ছিল জমিদার- বিরোধী ও ইংরেজ সরকার বিরোধী গণসংগ্রাম।


সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫ খ্রি:)


 ভূমিকা : সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় ও সরল প্রকৃতির এক কৃষিজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর ও পালামৌ অঞ্চলের গভীর বনভূমিতে তারা বসবাস করত এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেখানে কৃষিকাজ করত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলে এই অঞ্চল কোম্পানির রাজস্বের অধীনে আসে। জমিদার ও কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে তারা এই অঞ্চল ত্যাগ করে রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল ও মুরশিদাবাদের একাংশের বনভূমি পরিষ্কার করে সেখানে বসবাস ও কৃষিকাজ শুরু করে। তারা এই অঞ্চলের নাম দেয় 'দামিন-ই-কো' বা 'পাহাড়ের প্রান্তদেশ)


 বিদ্রোহের কারণ : এই অঞ্চলেও তারা জমিদার ও সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নানাভাবে জমিদার ও সরকার সরলপ্রাণ দরিদ্র সাঁওতালদের শোষণ করতে শুরু করে। (১) সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জঙ্গলাকীর্ণ পাথুরে জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করেছিল, কিন্তু নতুন ভূমিব্যবস্থায় সেই জমির ওপর খাজনা ধার্য করা হয়। খাজনার হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। (২) চড়া হারে খাজনা ছাড়াও জমিদার ইজারাদারদের কর্মচারীরা নানাভাবে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপযুদ্ধ আদায় করত, যেগুলি মেটাতে তাদের নাজেহাল হতে হত। (৩) নতুন ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তে নগদ অর্থে খাজনা মেটাতে হত। তাই তারা মহাজনদের কাছে ফসল বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করত। দেশীয় মহাজনরা তাদের ঋণ দিত এবং অন্যায়ভাবে বেশি সুদ আদায় করত। সুদের হার ছিল ৫০ থেকে ৫০০%। একবার ঋণ নিলে ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব হত না। ঋণের দায়ে তাকে চাষের বলদ, জমির ফসল, জমি বিক্রি করতে হত—এমনকি নিজেকেও তাদের দাসে পরিণত হতে হত। (৪) বিদেশি মহাজন ও ব্যবসায়ীরা এখানে নানা জিনিসের দোকান খুলে বসে। ফসলের বিনিময়ে ওইসব দ্রব্য চড়া দামে কিনতে গিয়ে তারা সর্বস্বান্ত হত। দোকানদাররা ভূয়া বাটখারায় মালপত্র কেনাবেচা করে তাদের ঠকাত। (৫) লর্ড ডালহৌসির আমলে রাজমহল, রামপুরহাট, ভাগলপুর, সাহেবগঞ্জ ● প্রভৃতি অঞ্চলে রেলপথ সম্প্রসারণের কাজ শুরু হলে ওইসব অঞ্চলে রেলের ইংরেজ কর্মচারী • ঠিকাদারদের আবির্ভাব হয়। তারা সাঁওতালদের নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করত। এ ছাড়া তারা জোর করে সাঁওতালদের হাঁস-মুরগি-ছাগল কেড়ে নিত—এমনকি সাঁওতাল মেয়েদের সম্মানে হাত দিতেও কুণ্ঠা বোধ করত না। (৬) নীলকর সাহেবরা সাঁওতালদের জোর করে নীলচাষে বাধ্য করত। এর অন্যথা হলে পুরো সাঁওতাল পরিবারের ওপরেই নির্যাতন চলত। (৭) সাঁওতালরা এতদিন তাদের নিজস্ব আইন দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল, কিন্তু বাংলার ছোটোলটি ফ্রেডারিক হ্যালিডের নির্দেশে তাদের ব্রিটিশ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের অধীনে আনা হয়। এই আইন ছিল জটিল এবং এর বিচারও ছিল বায়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তাদের পক্ষে এসব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল। না। (৮) খ্রিস্টান মিশনারিরা নানা অছিলায় তাদের ধর্মান্তরিত করত। (৯) এই বিদ্রোহের পশ্চাতে ধর্মীয় উদ্দীপনাও বেশ কাজ করেছিল। ১৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের নেতা দিল ও কানু ঘোষণা করে যে, ঈশ্বর তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই বিদ্রোহে তাদের জয় হবেই, কারণ স্বয়ং ঈশ্বর তাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন। এইসব বক্তব্য নিরক্ষর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাঁওতালদের মনে গভীর আশার সম্ভার করে এবং তারা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়।




 বিদ্রোহের সূচনা: এইসব অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রথমেই তারা বিদ্রোহের পতাকা তুলে ধরেনি। প্রথমে তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করে। তারপর আবেদনের মাধ্যমে তাদের সমস্যা মিটবে না বুঝে বিদ্রোহের কথা চিন্তা করে। সিধু ও কানু নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন ভাগনাডিহির মাঠে দশ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। ৭ই জুলাই তারা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা ক'রে বহু মহাজন ও জমিদারকে হত্যা করে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায়। তারা পাকুড়ের রাজবাড়ি দখল করে। সিধু, কানু ছাড়াও চাঁদ ও ভৈরব নামে দুই ভাই এবং বীর সিং কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহীদের সংখ্যা ক্রমে ৫০ হাজারে পৌঁছোয়। তিরধনুক ও বল্লম নিয়ে বীর যোদ্ধারা সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত কার্যত ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। ক্রমে বীরভূম ও মুরশিদাবাদের একাংশেও এই বিদ্রোহ বিস্তৃত হয়। অবশেষে ২৩ হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সিধু-কানু ও অন্যান্য নেতার ফাঁসি হয়।


 বিদ্রোহের চরিত্র: সাঁওতাল বিদ্রোহ মূলত ছিল কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ কেবল। একটি উপজাতি বিদ্রোহ-ই নয়—এটি ছিল ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবীদের সংঘবন্ধ প্রতিবাদও। সাঁওতালদের সঙ্গে স্থানীয় কুমোর, তেলি, কামার, গোয়ালা, মুসলিম তাঁতি, চামার, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায় ও পেশার মানুষও এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ এর মতে, এই বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। সাঁওতাল যুবকরা এই বিদ্রোহের মূলশক্তি হলেও কিশোর, বৃদ্ধ এবং নারীরাও এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। সাঁওতাল নারীরা সন্তান কোলে নিয়ে কারাবরণ করে। এই বিদ্রোহ শুধু জমিদার ও মহাজন-বিরোধী ছিল না, তা স্পষ্টতই ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী।


 বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব : সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর পরোক্ষ ফল ছিল। সুদূরপ্রসারী। ঐতিহাসিক ড. কালীকিঙ্কর দত্ত বলেন যে, বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ এক নবযুগের সূচনা করে ("This episode opened a new chapter in the history of Bengal and Bihar. "The Santal Insurrection of 1855-57, K, K. Datta, P. 69)। (১) ড. দত্তের মতে, এই বিদ্রোহকে গুরুত্বহীন আঞ্চলিক বিদ্রোহ বলা অনুচিত ("This insurrection cannot be regarded as a mere local rising of no importance.")। এই বিদ্রোহ কেবল সাঁওতালদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উইলিয়াম হান্টার বলেন যে, সাঁওতাল ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী আধা-আদিবাসীশ্রেণি ও নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুরাও এই বিদ্রোহে যোগ দেয়। (২) বিদ্রোহ দমনের পর কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের সম্পর্কে কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। সাঁওতাল-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে 'সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করে। তাদের পৃথক 'উপজাতি' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ঘোষণা করা। হয় যে, এখানে ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না। এখানে ইউরোপীয় মিশনারি ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়। এইভাবে ভারতীয় জনজীবন থেকে সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন করে সরকার তাদের অনুন্নত অবস্থাতেই রেখে দেয়। (৩) এই অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিরা সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যবোধ সৃষ্টিতে তৎপর হয়। (৪) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত। সুপ্রকাশ রায় বলেন, “এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিল এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ।"


No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();