ডিরোজিও এবং নব্যবঙ্গ (Derozio and Young Bengal)| রামকৃষ্ণমিশন| আর্যসমাজ| ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর|আলীগড় আন্দোলন |
সূচনা: বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হিন্দু কলেজের ২২ বছর তরুণ শিক্ষক পোর্তুগিজ বংশোদ্ভূত হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১ খ্রি.) এর অভি উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর নেতৃত্বে কিছু আদর্শবাদী তরুণ হিন্দুধর্ম ও সমাজের ওপর সকল শুদ্ধা হারিয়ে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে দেশে এক চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তারুণ্যের তেকে উদ্দীপ্ত এই আন্দোলনের ফলে হিন্দুধর্ম ও সমাজের ভিত কেঁপে ওঠে। এই আন্দোলন 'নব্যবসা আন্দোলন বা ইয়াবোল মুভমেন্ট' নামে পরিচিত। শিক্ষক ডিরোজিও এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ডিরোজিও-র জন্ম ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে এক ইচ্ছা-পোর্তুগিজ পরিবারে। কবি, যুক্তিবাদী ও স্বাধীনচি পুজারি ডেভিড ড্রামন্ডের 'ধর্মতলা একাডেমি-তে তিনি শিক্ষালাভ করেন। ডিরোজিওর ওপর তাঁর প্রভাব ছিল অসামান্য। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৮২৭ বা ১৮২৮ খ্রি.) মাত্র সতেরো বছর ব্যাসে তিনি হিন্দু কলেজে ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন উ বাংলার এক প্রদীপ্ত প্রলয়শিখা। জাতীয়তার রাজ রামমোহন ভারতে যে মহাযজ্ঞের সূচনা করেন, তিনি তাতে ঘৃতাহুতি দেন। যুক্তিবাদী, ডিরোজিও বিনা বিচারে কিছুই মানতেন না এবং ছাত্রদেরও অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদী ও সত্যসন্ধানী হওয়ার পরামর্শ দিতেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। তাঁর চেষ্টায় ছাত্ররা লক, হিউম, বেকন, faceforo বার্কলে, রীড, টম পেইন, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখ দার্শনিক এবং ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। সাধারণ অর্থে শ্রেণিকক্ষ বলতে আমরা যা বুঝি ডিরোজিও-র ক্লাস তা ছিল না। সেখানে সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, দেশপ্রেম—সব কিছু নিয়ে অবাধ আলোচনা চলত। এর উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীনচিন্তা ও যুক্তিবাদের উন্মেষ ঘটানো।
মতাদর্শ : ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও মানিকতলার মোমেনিকেশন নামে এক বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত এটিই ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন। এখানে তাঁর ছাত্ররা প্রচলিত অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করত। জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, প্রতিমা পূজা, সতীদাহ ও প্রচলিত হিন্দুধর্ম ছিল তাঁদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। 'এদেনিয়াম' ছিল এই সংঘের মুখপত্র। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা 'পার্থেনন' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে স্ত্রীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ডিরোজিও-র উদ্যোগে প্রকাশিত 'ভ্যালেইডোস্কোপ' পত্রিকা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। তাঁরা হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। তাঁরা নিষিদ্ধ মাসে ভক্ষণ করতেন, উপবীত ছিঁড়ে ফেলতেন, গলাজলের পবিত্রতা মানতেন না, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের লক্ষ্য করে বলতেন— "আমরা গোরু খাই গো”, কালীঘাটের মন্দিরে মা কালীর উদ্দেশে বলতেন--Good morning, Madam। " তাঁর অনুগামীদের হিন্দুধর্ম-বিরোধী
এইসব মতামত ও কার্যকলাপে হিন্দুসমাজে প্রবল আলোড়ন দেখা দেয়। ফলে তিনি হিন্দু কলেজ থেকে পদচ্যুত হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
কার্যকলাপ : পোর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয় ছিলেন। সম্ভবত ডিরোজিও-ই আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয়তাবাদী কবি। তাঁর রচিত 'ফকির অব 'জঙ্গিরা' ও 'স্বদেশের প্রতি' ('To My Country') কবিতায় দেশাত্মবোধ ফুটে উঠেছে। তিনি ও তাঁর অনুগামীরা মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে গভীরভাবে ভালোবাসলেও ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একান্তভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁদের কালাপাহাড়ি মনোভাবের জন্য দেশবাসীও তাঁদের গ্রহণ করেনি। ডিরোজিও-র মৃত্যুতে তাঁর আদর্শ লুপ্ত হয়নি—তিনি স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ইয়ংবেঙ্গাল' নামে একদল অনুগামী রেখে যান। ভারতীয় নবজাগরণের ইতিহাসে তাঁরা সকলেই বিশিষ্ট স্থানাধিকারী। তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিকতৃত্ব মাত্রিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা জানাবে, 'এনকোয়ারার', 'বেঙ্গাল স্পেকটেটর', 'হিন্দু পাইওনিয়ার" নামে পত্রিকা এবং সাধারণ জ্ঞানোপার্টিকা সভা' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনৈতিক কার্য পরিচালনার জন্য ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা বোল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি” প্রতিষ্ঠা করেন। তারা খ্রিস্টান পাদ্রিদের গোঁড়ামি, স্ত্রীপুরুষের অ-সমানাধিকার, দাসপ্রথা, নারীনির্যাতন, সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণবিধি, মরিশাসে ভারতীয় কুলি প্রেরণ, ভারতীয় বিচার ও পুলিশ ব্যবস্থা, বেগার খাটানো, একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং অন্যান্য সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক কুসংস্কার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
ব্যর্থতা: এই আন্দোলনের ব্যর্থতার নানা কারণ ছিল। (১) তাদের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না-তাদের সব চিন্তাধারাই ছিল নেতিবাচক। তাঁরা যে কী চান, তা-ই তারা ঠিকমতো জানতেন না। হিন্দুধর্ম বা পাশ্চাত্য সভ্যতা কোনোটি সম্পর্কেই তাঁদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সব কিছু না জেনেই তাঁরা তার নিন্দায় সোচ্চার হয়েছিলেন। এর ফলে হিন্দুসমাজে ত্রাসের সম্ভার হয়। এই আন্দোলনের পশ্চাতে কোনো জনসমর্থন ছিল। না। (২) এই আন্দোলন কিছু শহুরে তরুণ বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাঁরা বক্তৃতা ও পুস্তিকার মাধ্যমেই তাঁদের আন্দোলন চালাতেন। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। ড. অনিল শীল-এর মতে, "তাঁরা গজদন্ড মিনারে বাস করতেন" ("They lived in ivory towers.")। (৩) দেশের দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষের সমস্যাবলি। সম্পর্কে তাঁরা অবহিত ছিলেন না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন বা কুটির-শিল্পের ধ্বংসের ফলে সৃষ্ট শোচনীয় আর্থিক দুর্দশা থেকে তাদের মুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা তাঁরা গ্রহণ করেননি। (৪) মুসলিম সমাজের সঙ্গে এঁদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। (৫) ডিরোজিও-র মৃত্যুর পর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস স্তিমিত হলে তাঁদের অনেকেই চিরাচরিত ঐতিহ্যের ক্রোড়ে আশ্রয় নেন। অনেকেই সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন বা ব্যাবসায় মন দেন। হরচন্দ্র ঘোষ বাঁকুড়ার সদর আমিন নিযুক্ত হন। গোবিন্দচন্দ্র বসাক, রসিককুয় মল্লিক ও মাধবচন্দ্র মল্লিক ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। কিশোরীচাদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। রাধানাথ শিকদার জরিপ দপ্তরে চাকরি নেন এবং হিমালয়ের উচ্চতা মেপে বিখ্যাত হন। প্যারীচাঁদ মিত্র 'ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি'র সম্পাদক নিযুক্ত হন। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করে অযোধ্যার তালুকদারি পান এবং ১৮৭১-এ 'রাজা' উপাধি লাভ করেন।
গুরুত্ব: ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের কাজকর্মের মূল্যায়ন সম্পর্কে সমকাল ও পরবর্তীকালে নানা মতপার্থক্য দেখা গেছে। অনেকে তাঁদের সম্পর্কে উচ্ছৃঙ্খল', 'কালাপাহাড়', 'সমাজবিচ্ছিন্ন উগ্রগোষ্ঠী' প্রভৃতি মন্তব্য করেছেন। আবার অনেকে তাঁদের মধ্যে দেখেছেন 'নবজাগরণের ঊষালগ্ন। কিশোরীচাঁদ মিত্র তাঁদের 'কাব্যনজঙ্ঘার চূড়া'-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, এঁদের মধ্যেই 'প্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আদর্শের সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়েছিল। কৃষ্ণদাস পাল তাঁদের 'দেশের ভবিষ্যৎ' বলে অভিহিত করেন। অনেকে বলেন যে, তাঁরা হলেন হঠাৎ আলোর ঝলক "এক প্রজন্মেই তাঁদের সব শেষ, তাঁদের কোনো পিতা এবং সন্তানসন্ততি নেই” ('a generation without fathers and children")। বিনয় ঘোষ তাঁদের কখনোই প্রগতিশীল বলতে রাজি নন। ড. অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁদের আন্দোলনের কোনো অর্থ খুঁজে পাননি। তাঁর মতে, ইয়ংবেঙ্গালরা হলেন "নকলনবিশের দল'—তাঁরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ করেছিলেন মাত্র। ড. সুমিত সরকার বলেন যে, সামান্য বুদ্ধিজীবী অংশ ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর এদের প্রভাব ছিল শূন্যের কোঠায়। নানা ত্রুটি সত্ত্বেও জাতীয় জীবনে এই গোষ্ঠীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'A Nation in Making' গ্রন্থে বলেছেন যে, তাঁরা ছিলেন “বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক- তারা আমাদের জাতির পিতা, তাঁদের গুণাবলী চিরস্মরণীয়।" @ প্রার্থনাসমাজ (১৮৬৭ খ্রি:) (The Prarthana Samaj ) ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে আত্মারাম পাণ্ডুরা (১৮২৩- ৯৮ খ্রি.)-র নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে 'প্রার্থনাসমাজ' প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে বিচারপতি মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে (১৮৪২-১৯০১ খ্রি.) ও ঐতিহাসিক রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর (১৮৩৭- ১৯২৫ খ্রি.) এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। তাঁরা বেদের অপৌরুষেয়তা, জন্মান্তরবাদ, অবতারবাদ ও পৌত্তলিকতার বিরোধী এবং একেশ্বরবাদের সমর্থক হলেও কখনোই ব্রায়- সমাজের মতো হিন্দুধর্ম বা হিন্দুসমাজ-বিরোধী বলে নিজেদের ঘোষণা করেননি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং তুকারাম, জ্ঞানেশ্বর প্রমুখ ভক্তিবাদী সত্তদের আদর্শ থেকেই তাঁরা তাঁদের মূল নীতিগুলি গ্রহণ করেন। ধর্ম অপেক্ষা সমাজসংস্কারেই তাঁরা বেশি আগ্রহী ছিলেন। সমাজ উন্নয়ন ও নারী- কল্যাণের ক্ষেত্রে তাঁরা অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ, অস্পৃশ্যতা বর্জন, পর্দাপ্রথা বর্জন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রদ, মদ্যপান নিবারণ, সমাজের দুঃস্থদের উন্নয়ন, স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার, নারীমুক্তির আদর্শ প্রচার এবং শিশুসদন, অনাথ আশ্রম, বিধবা আশ্রম, চিকিৎসালয় স্থাপন প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করেন। প্রার্থনাসমাজের উদ্দেশ্য সফল করে তোলার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ মহাদেব গোবিন্দ রানাডে বিধবাবিবাহ সমিতি' (১৮৬১ খ্রি.) ও দাক্ষিণাত্য শিক্ষাসমাজ' (১৯৮৪ খ্রি.) গঠন করেন। দাক্ষিণাত্য শিক্ষাসমাজ-এর উদ্যোগে কোনো প্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত হয় পুনার 'ফারগুসন কলেজ" এবং সাংলি-র উইলিংডন কলেজ'। ভারতবাসীর রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে রাণাডে পুনায় সার্বজনিক সভা (১৮৭০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। দীনবন্ধু' এন্ড্রজ এর মতে, সংস্কারক হিসেবে তিনি রামমোহন ও স্যার সৈয়দ আহমদের প্রায় কাছাকাছি ছিলেন। মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও অম্লের তেলুগ ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রার্থনাসমাজ' বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
শ্রীরামকৃত স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন (Ramakrishna Vivekananda and Ramakrishna Mission) খ্রিস্টান মিশনারি ও ব্রাহ্মসমাজেরা আক্রমণের হাত থেকে হিন্দু ধর্ম ও সমাজকে রক্ষার উদ্দেশ্যে রামমোহন রায়ের সময় থেকেই হিন্দুসমাজে এক আক্রমণাত্মক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা 'নব্যহিন্দু আন্দোলন' নামে পরিচিত। রাধাকান্ত দেব, পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ও শিবচন্দ্র বিদ্যাগৰ এই আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নায়ক। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন প্রমূখ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের বক্তব্যও 'নবাহিন্দু আন্দোলন'-কে শক্তিশালী করে তোলে। একদা ইয়ংবেঙ্গাল' গোষ্ঠীভূক্ত ভূদেব মুখোপাধ্যায় হিন্দুর বেদ-উপনিষদ-পুরাণ ও হিন্দুর সকল আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। বঙ্কিমচন্দ্র পৌরাণিক হিন্দুধর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য মুক্তিবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে নয়াহিন্দুত্বের শুনিয়াদ খাড়া করতে সচেষ্ট হন। 'ধর্মতত্ত্ব' ও কৃষ্ণচরিত্র' গ্রন্থে তাঁর ধর্মীয় চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে। জাতীয় জীবনের এই প্রেক্ষাপটে দের স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভা ঘটে। তাঁদের আবির্ভাব ও কার্যকলাপ ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে এবং হিন্দুধর্ম সহজসরল, উদার ও সর্বজনীন হয়ে ওঠে। 6 শ্রীরামকৃষ্ণ © ধর্মীয় আদর্শ : আধুনিক ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-৮৬ খ্রি.)। তথাকথিত শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতিহীন, পাশ্চাত্য-জ্ঞানবর্জিত এই পরিত্র পুরোহিত নিজ জীবন ও সাধনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন ভারতীয় দর্শন, সংস্কৃতি ও সাধনার সত্যতা। (১) বৈষ্ণব ও শাঙ্ক সাধনার বিচিত্র পথ, ইসলাম থেকে খ্রিস্টীয় সাধনা, দ্বৈত থেকে অদ্বৈত, সাকার থেকে নিরাকার, সগুন থেকে নির্গুণ—সব সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভেন জর্জরিত পৃথিবীকে তিনি জানালেন যে, সব পথ দিয়েই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়— “যত মত তত পথ'। (২) তিনি স্পষ্টই বলেন যে, ঈশ্বরলাভের জন্য পান্ডিতা, শাস্ত্রজ্ঞান, তন্ত্র, আচার-অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ, শাস্ত্রীয় বিধি, কুস্তুসাধনা, সংসারত্যাগ, অপরূপ বা শুচিতার প্রশ্ন অপরিহার্য নয় - আন্তরিকতাকে সম্বল করেই যে-কোনো মানুষ স্বাধীনভাবে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। (৩) ঈশ্বরের নামে কর্মত্যাগ, কর্তব্যকর্মে অবহেলা ও সর্বপ্রকার পলায়নপর মনোবৃত্তিকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। তিনি সংসার ত্যাগ করতে বলেননি, ত্যাগ করতে বলেছেন সংসারে আসক্তি। কর্মত্যাগের কথা বলেননি, বলেছেন নিষ্কাম কর্মের কথা। তাঁর কাছে ধর্মের অর্থ উদাসীনতা না। -কর্মে আহ্বান, দায়িত্ববোধ ও জীবজগতের কল্যাণসাধন। (৪) জীবে দয়া নয়— শিবজ্ঞানে জীবসেবা'। তাঁর জীবন ও সাধনা প্রমাণ করে যে, হিন্দুরা পৌত্তলিক নয়, তারা মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীর উপাসনা করে, ভগবান লাভই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং সাধনমার্গের সব পথই সত্য ও অভ্রান্ত। ® মানবতাবাস: মানবমহিমার জয়গান গেয়ে তিনি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, নারীমুক্তি, সেবাদর্শ ও মানব হিতৈষণার কথা প্রচার করেন। (১) মানুষের মহত্বে বিশ্বাসী শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন যে, প্রত্যেক মানুষই হল অনন্তশক্তির আধার এবং চৈতন্যের পথে অগ্রসর হওয়াই হল মানুষের ধর্ম। পাপীতাপী, মদ্যপ, নাস্তিক, দুষ্কৃতকারী, পণ্ডিত, সজ্জন—সকলেই সেই
'রে' দিকে এগিয়ে চলেছে। (২) হতাশাগ্রত মানুষকে আত্মবিশ্বাসের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত। করে তিনি বলেছেন যে, প্রত্যেক মানুষই মুক্তপুরুষ, ঈশ্বরের সন্তান, রাজাধিরাজের পুত্র। (৩) ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নারীমুি আদর্শকে তিনি পূর্ণতার পথে এগিয়ে দেন। তাঁর কাছে নারী হল তার প্রতিমূর্তি। কেবল নারীর মহিম ঘোষণাই নয়—নারীজাতির দুর্দশামোচন ও সেকাজে নারীর নেতৃত্বকে স্বীকৃতি জানিয়ে নারীর মহিমাকে তিনি আরও উঁচুতে তুলে ধরেন। (৪) তাঁর প্রচারের ফলে জাতপাতে বেড়াও ভেঙে যায় এবং আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব কৃত্রিম হিন্ প্রাণবন্ত ও সহজসরল হয়ে ওঠে। • প্রভাব: ঐতিহাসিক চার্লস হেমস্যাৎ ভারতীয় জাতীয় চেতনার বিকাশ ও বাঙালি মানসের ওপর 'বাংলার ডায়নামিক শক্তিযুক্ত মিষ্টিক' ধীরামকৃষ্ণের সীমাহীন প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। পাশ্চাত্য মনীষী আমোরি ডি রিনকোর্ট ভারতীয় ইতিহাসে সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও চমকপ্রদ 'মিস্টিক' শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। বিপ্লবী নায়ক অরবিন্দ ঘোষের মতে, বাংলার পুনর্জাগরণে শ্রীরামকৃষ্ণের অবদানই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তাঁর দ্বারাই ভারতের মুক্তি ও পুনরুত্থানের কাজ শুরু হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ © নবভারতের কল্পনা: শ্রীরামকৃষ্ণ সাধনার সার্থক উত্তরাধিকারী, জ্বলন্ত দেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাসের মূর্ত প্রতীক স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬০-১৯০২ খ্রি.) জীবন ও বাণী বিদেশি শাসনে নির্যাতিত, ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন, হীনম্মনা ও মুমূর্ষু ভারতবাসীকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলে। (১) অদ্বৈতবাদী এই সন্ন্যাসী হতাশারির ভারতবাসীকে 'অ' হু, মানবপ্রেম ও স্বদেশপ্রেমের আদর্শে জীক্ষিত করে বলেন, আত্মবিশ্বাসহীন মানুষই নাস্তিক এবং মানুষকে পাপী বলা পাপ। (২) তিনি বলেন, “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী, বল ভাই- ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাশ।" তিনি বলেন যে, জন্ম থেকেই মানুষ 'মায়ের' জন্য বলিপ্রদত্ত। এই মা হলেন দেশমাতা। দেশবাসীকে তিনি জানান যে, অন্যান্য দেবদেবীকে বাদ দিয়ে আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য ভারতমাতাই যেন সবার একমাত্র আরাধ্যা দেবী হন। (0) Man-making religion/ মানুষ তৈরির ধর্ম'। এই 'মানুষ' তৈরির টিদ্দেশ্যেই ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নবভারতের আনন্দমঠ' রামকৃষ্ণ মিশনা জাতীয়চেতনা, মানবতাবাদের সাধনা এবং ভারতবাসীর আত্মিক ও বৌদ্ধিক মুক্তির ইতিহাসে।
উনিশ শতকের ভারতে সামাজিক ও সাংস্কৃতি এই প্রতিষ্ঠানের নাম অ (8) de om myfee feges felce) were fe হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি অদাশীল করে তোলেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রাচ্য-পাশ্চার্য এবং আদর্শের সমে সহযোগিতায় নবভারত গঠন করতে, যেখানে প্রাচীন ভারতীয় জীবনাদর্শের সঙ্গে পাশ্চাত্যের কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটবে। (৬) তিনি উপলব্ধি করেন যে, দেশের প্রকৃত শক্তি হল। সাধারণ জনজীবীরাই কথিত নীচজাতির উন্নতির মাধ্যমেই নাভাল • স্বামী এক ছিলেন। তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে নামেননি যদি বক্তৃতা ও বিভিন্ন চিঠি পরে তাঁর উপ রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ পেয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের রক্তরাঙা দিনগুলিতে স্বামীজি ছিলেন দেশপ্রেমিকদের আদর্শ। তাঁর বাণী ছিল সকল বৈপ্লবিক প্রেরণা। সমযোগ, রাজযোগ ছিল ন রবিন্দ ঘোষের মতে, "বিবেদেই আমাদের তিনিই ইহার প্রধান কে . . আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক' বলে আখ্যায়িত করেছেন 'Swami Vivekananda might wel be called the father of modern Indian Nationalism.") রামকৃষ্ণ মিশন জীরামকৃষ্ণের শিবজ্ঞানে জীবসেবা'-র আদর্শকে বাস্তব রূপ দেওয়ার উদ্দেশে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে স্থান নেন নিশনের অভিজ্ঞাপে এর কয়েকটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে (১) মানবের হিতার্থে শ্রীরামকৃষ্ণ যেসব তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন বা নিজ জীবনে প্রয়োগ করেছেন সেগুলি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা। (২) মানুষের সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বিদ্যাদানের উপযুক্ত লোক শিক্ষিতকরণ, শিল্প ও শ্রমজীবীদের উৎসাহবর্তন এবং বেদান্ত ও অন্যান্য ধর্মভাব জনজীবনে প্রব শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত নবভারতের 'আনন্দমঠ' রামকৃষ্ণ মিশন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেশগঠন ও জাতিগঠনে রত। 'মানুষ' তৈরি, শিক্ষাবিস্তার, সমাজসেবা এবং জাতিগঠনই তার প্রধান লক্ষ্য। স্কুল-কলেজ, পাঠাগার, ঔষধালয়, অনাথাশ্রম, হাসপাতাল পরিচালনা, দারিদ্র্যা পীড়িত মানুষের উন্নয়ন এবং বন্যা, খরা ও দুর্ভিক্ষে নিপীড়িত মানুষের সেবায় মিশনের সন্ন্যাসীরা নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত মুক্তি বা মোক্ষের উর্ধ্বে উঠে সমাজসেবা ও জাতিগঠনই রামকৃষ্ণ মিশনের লক্ষ্য। ভারতের অভ্যন্তরে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ৮৩টি শাখা আছে। ভারতের বাইরেও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ১১২টি শাখা স্থাপিত হয়েে ৭ থিওসফিক্যাল সোসাইটি (Theosophical Society) ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মাদাম ব্রাডটিস্কি ও কর্নেল এইচ. এস. ওলকট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে 'থিওসফিক্যাল সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা মাদ্রাজের আদিয়ারে এই সোসাইটির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। (১) বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্মতিস্থাপন
(২) প্রাচীন হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যকে পুনর্জাগরিত করে ভারতের সামাজিক সমস্যা ও রাজনৈতিক পরাধীনতার অবসান ঘটানো এর উদ্দেশ্য ছিল। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত এই সোসাইটিতে যোগদান করলে এই প্রতিষ্ঠান জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ভারতের নানাস্থানে তার শাখাপ্রশাখা স্থাপিত হয়। তাঁরা 'থিওসফি' নামে একটি ইংরেজি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। শ্রীমতী বেসান্ত বারাণসীতে 'কেন্দ্রীয় হিন্দু বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে মদনমোহন মালব্যের প্রচেষ্টায় তা বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়-এ রূপান্তরিত হয়। ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য অর্জন না করলেও আধুনিক ভারতের বিকাশে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান উল্লেখযোগ্য। এতদিন খ্রিস্টান মিশনারি সম্প্রদায় ভারতীয় ধর্ম ও সভ্যতার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছিল। হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী পাশ্চাত্য থিওসফিস্টরা হিন্দু ঐতিহ্যের পক্ষে প্রচারে নামলে ভারতীয়নের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে।
আর্যসমাজ (১৮৭৫ খ্রি:) (Arya Samaj )
আদর্শ: উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট এবং বিশেষত পাঞ্চাবের জনজীবনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-৮৩ খ্রি.) ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'আর্যসমাজ' এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রায়, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ই এপ্রিল স্বামী দয়ানন্দ বোম্বাইতে আর্যসমাজ' প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সকল চিন্তাধারা ও আদর্শের ভিত্তি ছিল বেদ। বৈদিক যুগের গৌরব এবং পবিত্রতায় হিন্দুধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর কাছে বেদই ছিল চরম, পরম ও অভ্রান্ত সত্য— সর্বজ্ঞানের আকর। বৈদিক-উত্তর যুগের ধর্মগ্রন্থ—পুরাণ, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের প্রতি তাঁর কোনো শ্রদ্ধা ছিল না। তিনি ছিলেন গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদ-বিরোধী এবং একেশ্বরবাদের সমর্থক। তিনি নারীস্বাধীনতা, স্ত্রীশিক্ষা, নারীপুরুষ সমানাধিকার ও উভয়ের চর্য পালন, বিধবাবিবাহ, সমুদ্রযাত্রা ও সংস্কৃত ভাষার উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি বৈদিক শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের সমন্বয় চেয়েছিলেন। তিনি সুখি আন্দোলনের' মাধ্যমে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরে আনতে সচেষ্ট ছিলেন এবং এই পন্থার প্রথম প্রবর্তক ছিলেন তিনিই। সত্যার্থ প্রকাশ' ও 'বেদ ভাষা' নামক হিন্দি গ্রন্থে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বিশেষত পাঞ্জাবে তাঁর ভাবধারা অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে একথা ঠিকই যে, ১৮৮৩, খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুকালে আর্যসমাজের সদস্যসংখ্যা ছিল ২০ হাজারেরও কম। স্বামী দয়ানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামী লালা হংসরাজ, পণ্ডিত গুরু দত্ত, লালা লাজপত রায়, স্বামী প্রধান (লালা মুনশী রাম) এই আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লালা হংসরাজ লাহোরে দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক কলেজ" প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্বামী অখানন্দ। হরিদ্বারে 'গুরুকুল আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন বৈদিক রীতিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
গৃরুত্ব: ভারতীয় জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রচারকার্যের ফলে (১) হিন্দুদের হীনম্মন্যতা দূর হয়, (২) বৈদিক হিন্দুধর্ম তার হৃতগৌরব ফিরে পায়, (৩) হিন্দু জনসাধারণ নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং (৪) হিন্দুসমাজে বিভিন্ন জাতপাতের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। (৫) আর্যসমাজের উদ্যোগেই হিন্দুধর্ম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং এক সর্বগ্রাসী শক্তিতে পরিণত হয়। (৬) এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, রাজা রামমোহন রায় বা রাগাডে-র আন্দোলন কেবল মুষ্টিমেয় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু আর্যসমাজের আন্দোলন ছিল গণমুখী — স্বামী দয়ানন্দই সর্বপ্রথম জনসাধারণকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন। ড. অমলেশ ত্রিপাঠী ভারতে চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশে স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন (The Extremist Challenge, P. 30-39) সমাজসংস্কার আন্দোলন (Social Reform Movement) রায়সমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন, প্রার্থনাসমাজ, আর্যসমাজ পরিচালিত আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ধর্ম এবং ধর্মকে কেন্দ্র করেই এইসব সংগঠন সমাজসংস্কারে ব্রতী হয়। অপরদিকে, এই সময়েই পর্যায়ক্রমে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ সমাজসংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে, নারায়ণ গুরু ও বিরসালিঙ্গম উল্লেখযোগ্য ছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজসংস্কারের কাজে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১ খ্রি.) নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। প্রচলিত অর্থে একজন সাধারণ সংস্কৃত পণ্ডিত হয়েও সমাজ-সচেতন ও মানবতাবাদী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বঙ্গীয় নবজাগরণের এক জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি। উনিশ শতকের ধর্মীয় বিবাদ-বিসম্বাদের দিনে 'করুণাসাগর' বিদ্যাসাগর বুদ্ধদেবের মতোই ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামাননি — মানুষই ছিল তাঁর কাছে মুখ্য, আর এই মানুষের মুতির জন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করে যান। ধুতি-চাদর ও তালতলার চটি পরিহিত এই তেজস্বী রায়ণের মধ্যে নবজাগরণের প্রবল যুক্তিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগাঢ় মানবতাবোধ এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।
শিক্ষাসংস্কার: ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়ে তিনি শিক্ষা- সংস্কারের কাজে ব্রতী হন। (১) পূর্বে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানরাই সংস্কৃত কলেজের ছাত্র হতে পারত। বিদ্যাসাগর এই প্রথা রদ করে সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকল বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। (২) পূর্বে অধ্যাপকদের কলেজে আসাযাওয়া ও অধ্যাপনার ব্যাপারে কোনো নিয়মকানুন ছিল না। তাঁরা যখন খুশি আসতেন ও চলে যেতেন। বিদ্যাসাগর সেখানে নিয়মশৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রবর্তন করেন। (৩) পূর্বে সংস্কৃত কলেজে হিন্দু তিথি ও শুভদিন অনুসারে ছুটি দেওয়া হত। বিদ্যাসাগর সে প্রথা তুলে দিয়ে রবিবার ছুটির নিয়ম প্রবর্তন করেন। (৪) সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রমেও তিনি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান। ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। সংস্কৃত পণ্ডিত হয়েও তিনি সাংখ্য ও বেদান্তকে 'প্রান্তদর্শন' বলে অভিহিত করে পাঠ্যসূচি থেকে সেগুলি বাদ দেন। মিল-এর তর্কশাস্ত্র পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গণিত শিক্ষার জন্য লীলাবতী ও বীজগণিত বাদ দিয়ে ইংরেজি গণিত পাঠ ব্যবস্থা করেন। সংস্কৃত ব্যাকরণ হিসেবে মুগ্ধবোধ" অসম্পূর্ণ ও প্রান্ত বলে তিনি তা বাতিল করেন এবং বাংলার মাধ্যমে সহজে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা "ব্যাকরণ কৌসুলী" রচনা করেন।
শিক্ষাবিস্তার: জনশিক্ষা বিস্তারের কাজেও তিনি আগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। (১) তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষাই অন্ধকার দূর করে মানুষকে প্রকৃত মুনাতে পৌঁছে দেয়। লর্ড হার্ডিস্কের সহযোগিতায় তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে গ্রামাঞ্চলে বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এগুলির মধ্যে ৩০টি স্থায়ী হয়। (২) বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিনি ২০টি মডেল স্কুল বা আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে অনেকগুলিই তিনি নিজ বায়ে চালাতেন। (৩) তিনি উপলব্ধি করেন যে, শিক্ষা বার্ত নারীসমাজের মুক্তি নেই। এ কারণে তিনি স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ড্রিঙ্কওয়াটার বেগুনের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যাসাগর এই শিক্ষায়তনের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে বাংলার গ্রামাঞ্চলে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলিতে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশোনা করত। প্রতিষ্ঠা। পরে এটি কলেজে উন্নীত হয়। বর্তমানে এর নাম "বিদ্যাসাগর কলেজ"। দেশীয় অধ্যাপকমণ্ডলীর দ্বারা পরিচালিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর প্রমাণ করেন যে, ভারতীয় অধ্যাপকরা ইংরেজ অধ্যাপকদের তুলনায় কোনো অংশে কম নন। (৫) কেবলমাত্র শিক্ষাবিস্তারই নয়—বিরাট পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তিনি জনশিক্ষার জন্য বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। এগুলির মধ্যে 'বর্ণমালা', 'কথামালা', 'বোধোদয়" উল্লেখযোগ্য। এককথায়, বাংলায় জনশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার এবং বাংলা গদ্যের বিকাশে তাঁর ভূমিকা অ ঈশ্বর বিশ্যাসাগর (৪) তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হল 'মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশন • বিবাহ বিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ এবং বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য আন্দোলনে নামেন এবং বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর মতামতের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সর্ব সভার মুখ সর্বমুক্তকরী পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই তিনি 'বাল্যবিবাহের দোষ' শীর্ষক এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। হিন্দু বাল্যবিধবাদের দুঃসহ জীবন তাঁকে প্রচণ্ড ব্যথিত করত। তিনি হিন্দুশাস্ত্র—বিশেষত 'পরাশ সংহিতা” থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। বিধবাবিবাহের পক্ষে তিনি দেশে এক প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এ সম্পর্কে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে পুস্তিকা দুটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর ভারতীয় আইনসভার সদস্যদের কাছে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করার জন্য এক হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর-সংবলিত এক আবেদনপত্র পাঠানো হয়। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই লর্ড ডালহৌসি বিধবা- বিবাহ আইন পাস করেন। বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হলেও তা কার্যকর করা ছিল খুবই দুরূহ কাজ। এই আইনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের পক্ষ থেকে ৩৬,৭৬৩ জনের স্বাক্ষর- সংবলিত একটি দরখাস্ত সরকারের কাছে পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর বাংলায় প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। পাত্র ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ব এবং পাত্রীর নাম কালীমতি দেবী। ঈশ্বরচন্দ্র নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রেরও বিধবা পারীর সঙ্গে বিবাহ দেন। তিনি নিজ উদ্যোগ ও ব্যয়ে বহু বিধবাবিবাহ দিয়েছিলেন।
বহুবিবাহের বিরোধিতা: হিন্দুসমাজে প্রচলিত বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও তিনি খড়গহস্ত ছিলেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহুবিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর-সংবলিত এক আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। স্থির ছিল যে, সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, কিন্তু ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহজনিত কারণে সরকার ভারতবাসীর সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এ সম্পর্কে আর কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এ সম্পর্কে তিনি দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন এবং প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন যে, বহুবিবাহ অশাস্ত্রীয়। যাই হোক, বিদ্যাসাগরের প্রচার ও শিক্ষাবিস্তারের ফলে বহুবিবাহের প্রকোপ বহুলাংশে হ্রাস পায়। উপসংহার: বিদ্যাসাগর ছিলেন বঙ্গীয় নবজাগরণের অন্যতম স্রষ্টা ও নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক। চিরাচরিত রক্ষণশীল পরিবেশে লালিত এবং সংস্কৃত পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতাকে তিনি সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে এই ভীরুর দেশে তিনিই ছিলেন একমাত্র 'পুরুষসিংহ'। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন এমন এক মানুষ "যাঁর মনীষা প্রাচীন ঋষিদের মতো, কর্মদক্ষতা ইংরেজের মতো এবং হৃদয়বস্তা বাঙালি জননীর মতো।” ড. অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁকে "একজন ঐতিহ্যবাহী আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা" ("a traditional moderniser") বলে অভিহিত করেছেন। জ্যোতিবা ফুলে উনিশ শতকে মহারাষ্ট্রের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে জ্যোতিবা ফুলে (১৮২৭- ১০ খ্রি.) একটি বিশিষ্ট নাম। তিনি একটি সম্পন্ন কুনবি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিক্ষালাভ করেন একটি স্কটিশ মিশনারি বিদ্যালয়ে। মহারাষ্ট্রের জনজীবনে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্য, জাতিভেদ প্রথা এবং শুদ্র ও নারীদের সীমাহীন দুর্দশা তাঁকে প্রবলভাবে ব্যথিত করে। এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর পত্নী সাবিত্রীবাঈ জেহাদ ঘোষণা করেন। (১) তিনি মনে করতেন যে, শুদ্রদের সামাজিক দাসত্ব বজায় রাখার জন্য ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রাদগুলি রচিত এবং হিন্দুধর্মের ইতিহাস হল শূদ্রদের ওপর রাহুশদের অত্যাচারের কাহিনি। তিনি কুনবি, মালি, মাও, মাহার প্রভৃতি তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে ব্রাহ্মণ- বিরোধী প্রচার শুরু করেন। তাঁর রচিত 'ব্রাহ্মণাচে কসাব (পুরোহিততন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন'), 'শ্বেতকাৰ্যচ অসুদ' কৃষকদের চাবুক) এবং গুলামগিরি' গ্রন্থে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিশ্বদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালানো হয়েছে। (২) তিনি ছিলেন ব্রিটিশরাজের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনিবিশ্বাস করতেন যে, ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের হাত থেকে শুদ্রদের রক্ষার জন্যই ভারে তিনি ইংরেজদের আগমন। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের কালে তিনি ইংরেজদের সমর্থন করেন, কার তাঁর মতে বিদ্রোহীরা সফল হলে ভারতে আবার ব্রাহ্মণ-রাজ প্রতিষ্ঠিত হত। (৩) করতেন যে, শুদ্রদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার হওয়া অত্যন্ত জরুরি, কারণ পাশ্চাত্যশিক্ষ গ্রহণের মাধ্যমেই শূদ্ররা নিজ অধিকার এবং তা রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠবে। (৪) নিম্নবর্ণের মানুষের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সত্যশোধক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমাজের মুখপত্র ছিল দীনমিত্র। জাতিভেদের বন্ধনমোচন এক নিম্নবর্ণের মানুষদের অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বস্তুত তিনি দক্ষিণ ভারতে অস্ত্রাগুণ আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। (৫) নারীকল্যাণের উদ্দেশে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিম্নবর্গের নারীদের জন্য তিনি একাধিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠ করেন। ব্যাজ বিদ্যাসাগরের মতো বিধবাবিবাহের ব্যাপারেও তিনি মহারাষ্ট্রে এক আন্দোলন গড়ে তোলেন। (৬) জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের ক্ষেত্রেও তিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহাত্মা' উপাধিতে ভূষিত হন। দক্ষিণ ভারতের বিশিষ্ট সাধক, সন্ন্যাসী ও চিন্তাবিদ শ্রীনারায়ণ গুরু (১৮৫৬-১৯২৮ খ্রি.) কেরালায় এজহারা সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধি তাঁর প্রতি যথেষ্ট শ্রধাশীল ছিলেন। উনিশ শতকের কেরালা জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার কঠিন নিগড়ে এমনই আবদ্ধ ছিল যে স্বামী বিবেকানন্দ কেরালাকে ভারতের উন্মাদ-আশ্রম' (lunatic asylum of India') বলে অভিহিত করেছেন। সন্ন্যাসী শ্রীনারায়ণ গুরু কেরালার সর্বত্র পরিভ্রমণ করে বর্ণবৈষম্য, সামাজিক অবিচার এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার চালান এবং অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর মূল বক্তব ছিল- “এক জাতি, এক ধর্ম এবং এক ঈশ্বর।" ১৮৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর উদ্যোগে কেরালার বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু মন্দির, মঠ ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। জাতিভেদ প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করার উদ্দেশ্যে এইসব প্রতিষ্ঠানের দরজা নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় উচ্চবর্ণের আরাধ্য দেবদেবীর মূর্তি এবং সেগুলির রন্ধনশালায় অস্পৃশ্যদের নিয়োগ করা হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্দির, মঠ ও বিদ্যালয়গুলির কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধনের উদ্দেশ্যে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় জীনারায়ণ ধর্ম পরিপালন যোগম" নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এজহারা সম্প্রদায়ের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উন্নতি, তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং দক্ষিণ ভারতে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনে এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। দক্ষিণ ভারতের ভাইকমে একটি হিন্দু মন্দিরমুখী রাস্তা নিম্নবর্ণের মানুষের বীরসালিঙগম আধুনিক অন্যের আদৃত, অ্য নবজাগরণের জনক', দক্ষিণ ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কাদুকরি বীরসালিাম পানতুলু (১৮৪৮-১৯১৯ খ্রি.) অগ্রপ্রদেশের রাজামুজিতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রবল দারি্যের মধ্যে তাঁর বালাজীবন অতিবাহিত হলেও স্বীয় প্রতিভাবলে ইতিহাসে তিনি এক স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে সামাজিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করা। তিনি জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, গণিকাবৃত্তি, রক্ষিতা পোষণ প্রকৃতির বিরোধী এবং বিষবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ এবং নারীশিক্ষার উন্ন সমর্থক ছিলেন। • ফেরৎ সাহিত্য: তেলুগু সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জনক বীরদালিলাম ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে 'বিবেকরধিনী' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর উদ্যোগে "চিন্তামণি', 'সতীহিতবোধিনী', 'সত্যবাদী' প্রভৃতি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এগুলির মাধ্যমে- তিনি একদিকে যেমন তেলুগু সাহিত্যের বিকাশ ঘটান, তেমনি অপরদিকে সমাজসংস্কারের আদর্শ প্রচারে ব্রতী হন এবং পদস্থ সরকারি আমলা ও বিচারকদের দুর্নীতি ও অত্যাচার জনসমক্ষে তুলে ধরেন। তিনিই প্রথম তেলুগু উপন্যাস, নাটক, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও ইতিহাস এদের রচয়িতা। তিনি মনে করতেন যে, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে প্ৰাৱল তেলুগু ভাষায় গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত। • শিক্ষা: তিনি শিক্ষা-বিশেষত নারীশিক্ষার উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। [ সোয়ালেখান (১৮৭৮ খ্রি.) ও রাজামুন্সিতে (১৮৮৪ খ্রি.) একটি করে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও তিনি বর্ষীয়সী মহিলাদের জন্য বিদ্যালয়, হরিজনদের জন্য বিদ্যালয় ও শ্রমিকদের জন্য নৈশবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। • নারী কল্যাণ : নারী-কল্যাণে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। (১) দক্ষিণ ভারতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বাল্যবিবাহ এবং কন্যা-শুল্কম' (বিবাহের জন্য কন্যা ব্রুয়)-এর বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং শাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করেন যে বাল্যবিবাহ শাস্ত্রসম্মত নয়। 'ব্রহ্মবিবাহস্থ' নাটকে তিনি বাল্যবিবাহ ও কন্যাশৃক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য তিনি 'রাজামুদ্রি সমাজসংস্কার সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। (২) সত্যরাজাচার্য পূর্বদেশ যাত্রালু' নামক ব্যঙ্গাত্মক নাটকের মাধ্যমে তিনি পুরুষদের বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্রুপ বর্ষণ করেন। (৩) তিনি বিধবাবিবাহের উগ্র সমর্থক ছিলেন। এ কারণে তাঁকে দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর' বলা হয়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিধবাবিবাহ সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর তাঁর উদ্যোগে দক্ষিণ ভারতের প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় রাজামুল্লিতে। তিনি মহীশূর (১৯০৭ খ্রি.) ও ব্যাঙ্গালোরে ((১৯১০ খ্রি.) একটি করে বিষবাশ্রম ও প্রতিষ্ঠা করেন। (৪) তিনি ধনবান ও অভিজ্ঞাত ব্যক্তিদের উপপত্নী বা রক্ষিতা পোষণের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানান। সাধারণত দেবদাসীদের রক্ষিতা হিসেবে নিযুক্ত করা হত। এর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। 'আধুনিক অস্ত্রের জনক' হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সৈয়দ আহমদ খান ও আলিগড় আন্দোলন
পটভূমি: ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় হিন্দুসমাজ ইংরেজ শাসন ও সভ্যতাকে স্বাগত জানায় এবং ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত হ্যা। অপরপক্ষে, ইংরেজ শাসনের সূচনা থেকেই মুসলিম সমাজ তার বিরোধী ছিল, কারণ মুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব করেই ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতা থেকে সযত্নে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে এবং এর ফলে সরকারি চাকরি থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। ইংরেজ সরকারও তাদের সন্দেহের চোখে দেখত। ওয়াহাবি আন্দোলন ও পরবর্তীকালে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে মুসলিম সমাজের ভূমিকায় ইংরেজ সরকার তাদের প্রতি অত্যন্ত বির হয়। এইভাবে শিক্ষাদীক্ষা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সরকারি চাকরি সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে মুসলিম সমাজ হতাশার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এই অবস্থায় মুসলিম সমাজের 'ত্রাণকর্তা' হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আবির্ভাব হয়। হিন্দুসমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য রাজা রামমোহন যা করেছিলেন, মুসলিম সমাজের মঙ্গলের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেন ("... he did for his community something like what Raja Rammohan Roy had done for the Hindus. "Dr. R. C. Majumdar, History of Freedom Movement in India, Vol I, P. 190 ) । সৈয়দ আহমদ খান
সৈয়দ আহমদ খানের পরিচয়: স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮ খ্রি.) দিল্লির এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইসলামীয় শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেন। ইংরেজ সরকারের অধীনে একজন কর্মচারী হিসেবে তাঁর জীবন শুরু হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের কালে তিনি বিজনোর-এর সদর আমিন' পদে নিযুক্ত ছিলেন। এবং এ সময় বহু ইংরেজ কর্মচারীর প্রাণ রক্ষা করে তিনি ইংরেজদের সুনজরে আসেন। ● সম্প্রীতি স্থাপন: মহাবিদ্রোহের পর তিনি ইংরেজ সরকার ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করেন এবং মুসলিম সমাজের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাবিস্তার ও সমাজ-সংস্কারে উদ্যোগী হন। মুসলিমদের তিনি ইংরেজদের প্রতি অহেতুক বিশ্বের ত্যাগের পরামর্শ দেন এবং বলেন যে, ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই মুসলিম স্বার্থ নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে। অপরপক্ষে, তিনি ইংরেজদের বোঝাতে সচেষ্ট হন যে, মুসলিমরা কখনোই ইংরেজ-বিরোধী নয়, মুসলিম ধর্মগ্রন্থে ইংরেজদের বিরুদ্ধে 'ধর্মযুদ্ধ ঘোষণার কথা নেই এবং ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ কোনোক্রমেই মুসলিমদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি। যদি কোনো মুসলিম এতে অংশগ্রহণ করে থাকে, তবে তা ভ্রান্তিবশতই করেছে। বলল বাহুল্য, সৈয়দ আহমদের উদ্দেশ্য সফল হয়। উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ও রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকারও তাঁদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে।
• মুসলিম সমাজে আধুনিকতার প্রসার; তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক সমাজসংস্কার ব্যতীত মুসলিম সমাজের গত্যন্তর নেই। মুসলিম রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে 'জেহাদ' ঘোষণা করে তিনি মুসলিম সমাজকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, পবিত্র কোরানই সকল জ্ঞানের আবার এবং মুসলিমদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ। চিরাচরিত রীতি, অজ্ঞতা, যুক্তিহীন সামাজিক প্রথা, গ্রন্থবিশ্বাস এবং সমাজের গোঁড়া ও ভ্রান্তবুদ্ধি সম্পন্ন মোল্লাদের সকল নির্দেশ না মেনে তিনি যুক্তি ও মানবতাবাদের আলোকে পবিত্র কোরানের ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দেন। তাঁর মতে, ধর্মের কোনো ব্যাখ্যা যুক্তি ও বিজ্ঞান-বিরোধী হলে তা পরিত্যাজ্য, পবিত্র কোরানে ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। তিনি নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষা বিস্তারের পক্ষে এবং পর্দাপ্রথা, বহুবিবাহ ও পত্নীকে 'তালাক' দেওয়ার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেন। মামাবিকতা ও যুক্তির আলোকে তিনি ইসলামকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হন। পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার: মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে (১) ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাজিপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। (২) জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রয়োজনীয় ইংরেজি গ্রন্থাবলি উর্দুতে অনুবাদ এবং সেগুলি মুসলিমদের মধ্যে প্রচারের জন্য ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'সায়েন্টিফিক সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। (৩) ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে প্রত্যাবর্তনের পর সমাজসংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি 'তাহজিব-আল-আফলাখ' নামে একটি উর্দু পত্রিকা এবং 'কমিটি ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব লার্নিং অ্যামং দি মহামেডান্স্ অব ইন্ডিয়া'নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। (৪) ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ আলিগড়ে 'অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় (১৯২০ খ্রি.)। সরকার এই কলেজটিকে প্রচুর অর্থদান করত। (৫) ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ 'মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন" নামে একটি সংস্থা স্থাপন করেন। এইভাবে তিনি মুসলিম সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে নবজীবনের সঞ্চার করেন। পরবর্তীকালে আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করেই মুসলিম সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিবর্তিত হয়। মুসলিম সমাজের এই জাগরণ আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত। বলাবাহুল্য, হিন্দু-বিদ্বেষ, বাঙালি-বিদ্বেষ, কংগ্রেস-বিদ্বেষ এবং ইংরেজ-তোষণই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান মূলধন। এই আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে ছিলেন চিরাগ আলি, আলতাফ হোসেন আলি, মৌলানা শিবলি নোমানি, নাজির আহম্মদ, কবি হালি, শিক্ষাবিদ খুদা বক্স।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি: জীবনের একটি পর্বে সৈয়দ আহমদ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা প্রচার করতেন। তিনি বলতেন, হিন্দু-মুসলিম এক জাতি—'একই জননীর দুই সন্তান'---'ভারতমাতার দুই চক্ষু। বাঙালিদের সম্পর্কেও তাঁর সীমাহীন শ্রদ্ধা ছিল। বাঙালিদের তিনি 'ভারতমাতার মাথার মুকুট' বলে মনে করতেন। এই সময় তিনি ইংল্যান্ড ও ভারতে একই সন্ধ্যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার দাবি জানান এবং ভারতের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেন। পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি প্রচার করতে শুরু করেন যে, হিন্দু ও মুসলিম কেবল দুটি পৃথক জাতিই নয় পরস্পর-বিরোধী স্বার্থযুক্ত এবং যুদ্ধরত দুটি পৃথক জাতি। মুসলিম সমাজকে তিনি ইংরেজ সরকারের প্রতি চরম আনুগত্যের কথা বলেন এবং জানান যে, ইংরেজদের হাতেই মুসলিমস্বার্থ নিরাপদ। আলিগড় ইন্সটিটিউট গেজেট' নামক পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাঙালিদের সম্পর্কে অবিরাম বিষোদ্গার করতে থাকেন। তাঁর মতে কংগ্রেস হল 'বাঙালি বাবুদের' স্বার্থে পরিচালিত একটি "হিন্দু সংগঠন' এবং কংগ্রেস আন্দোলন হল 'অন্তবিহীন গৃহযুদ্ধ' ('a civil war without arms )) একটা তিনি সিভিল সার্ভিস আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি তার ঘোরতর বিরোধিতা করে বলেন যে, স্বায়ত্তশাসন ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ সরকারি পদে নিয়োগের অর্থ হল হিন্দু কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া। বলা বাহুল্য, সৈয়দ আহমদের এই আদর্শেই আলিগড় আন্দোলন পরিচালিত হয়।
আন্দোলন পরিচালনার মুখপত্র ও সংগঠন সৈয়দ আহমদের সুহৃদ ও পরিচালক আলিগড় কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেকের পরিচালনাধীনে আলিগড় কলেজ এই ধরনের রাজনৈতিক প্রচারকার্যের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। অধ্যক্ষ বেক সম্পাদিত ইন্সটিটিউট গেজেট" নামক কলেজ পত্রিকা মারফত বাঙালি-বিদ্বেষ, হিন্দু-বিদ্বেষ ও কংগ্রেস-বিদ্বেষ প্রচার করা হত। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বেকের উদ্যোগে আলিগড়ে 'ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে হিন্দু সদস্যও ছিল এবং এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল এটাই প্রমাণ করা যে, জাতীয় কংগ্রেস হিন্দুদের একমাত্র সংগঠন নয়। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মূলত বেকের উদ্যোগেই মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব আপার ইন্ডিয়া' নামে কেবল মুসলিমদের নিয়ে আর একটি সংগঠন স্থাপিত হয়। মুসলিম স্বার্থরক্ষা ও ব্রিটিশ শাসনকে সুদৃঢ় করাই ছিল এই সংগঠনগুলির লক্ষ্য। সৈয়দ আহমদের মৃত্যুর পর এই আদর্শেই আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। © চারটি মৌলিক নীতি: চারটি মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে আলিগড় আন্দোলন পরিচালিত হয়। (১) হিন্দু-মুসলিম পরস্পর-বিরোধী স্বার্থযুক্ত দুটি যুদ্ধরত জাতি, (২) আয়ত্তশাসন বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ সরকারি পদে নিয়োগ মুসলিম স্বার্থবিরোধী, (৩) ব্রিটিশ সরকারের হাতে মুসলিমদের স্বার্থ সুরক্ষিত—এই কারণে সরকার- বিরোধী সর্বপ্রকার রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে তারা দূরে থাকবে এবং (৪) যেহেতু ব্রিটিশ সরকারের হাতে মুসলিম স্বার্থ নিরাপদ, সেজন্য তারা কেবল সাংস্কৃতিক উন্নয়নেই নিজেদের নিয়োজিত করবে এবং হিন্দু রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীদের খর্ব করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, তারা ঠিক সেটুকুই রাজনীতিতে অংশ নেবে। • সীমানা: সৈয়দ আহমদের সংস্কার প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। (১) গোঁড়া মৌলবি ও মোল্লারা তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টার বিরোধিতা করায় তাঁর ধর্ম ও সমাজসংস্কারের সকল উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। (২) এই আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ দরিদ্র ও পশ্চাদপদ মুসলিমদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। উত্তরপ্রদেশের কিছু জমিদার, উচ্চবিত্ত মানুষ ও চাকুরিজীবীর স্বার্থই ছিল এই আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি।
মূল্যায়ন: দ্বিজাতি তত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ প্রচারের জন্য আলিগড় আন্দোলন ও তার প্রবর্তক উভয়েই ঐতিহাসিকদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে যে, সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যও এই আন্দোলন দায়ি ছিল।
No comments:
Post a Comment