আঞ্চলিক শক্তির উত্থান অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বড় প্রশ্ন ও উত্তর| ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর | প্রশ্নের মান -৫|class 8 history 2nd chapter history brought question answer| - SM Textbook

Fresh Topics

Thursday, July 27, 2023

আঞ্চলিক শক্তির উত্থান অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বড় প্রশ্ন ও উত্তর| ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর | প্রশ্নের মান -৫|class 8 history 2nd chapter history brought question answer|

  আঞ্চলিক শক্তির উত্থান অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বড় প্রশ্ন ও উত্তর| ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর | প্রশ্নের মান -৫|class 8 history 2nd chapter history brought question answer|





ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নোত্তর


1. মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ উল্লেখ করো।



উত্তর:-  বাবর প্রতিষ্ঠিত মোগল সাম্রাজ্য আকবরের আমলে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পর থেকে নানা কারণে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়। 

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ:- 


(i) সাম্রাজ্যের বিশালতা:  সাম্রাজ্যের বিশালতা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম একটি কারণ। ঔরঙ্গজেবের সময় মোগল সাম্রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ঘটে। তাঁর আমলে মোট ২১টি মোগল সুবা ছিল। ঔরঙ্গাজেবের সময় পর্যন্ত সাম্রাজ্যের কোথাও বিন্নিতাবাদী আন্দোলন মাথা চাড়া না দিলেও তাঁর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের বিশালতার সুযোগ নিয়ে আঞ্চলিক শাসনকর্তাগণ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন হয়ে ওঠে।


সামরিক দুর্বলতা: সামরিক শক্তির দুর্বলতা ছিল মোগল সাম্রাজ্য পতনের অপর একটি কারণ। ঐতিহাসিক আরভিন দেখিয়েছেন যে, মোগল বাহিনীর ক্রমবর্ধমান দক্ষতার অভাব বিশৃঙ্খলা এবং নতুন যুদ্ধ সরঞ্জামের অভাবে মোগল বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। নানা কারণে মোগল বাহিনীর দুর্বলতা প্রকট হয়, যেমন— 1) বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায় নিয়ে গড়ে ওঠায় মোগল বাহিনী কখনোই জাতীয় বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

 2) জায়গিরদার ও মনসবদারদের দুর্নীতির ফলে সৈন্যবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। 

3) তা ছাড়া আকবর ছাড়া কেউই নৌবাহিনীর প্রতি বিশেষ নজর দেননি।


 অর্থ সংকট: শাজাহানের জাঁকজমকতা, শিল্পানুরাগ ও আড়ম্বরপ্রিয়তা, ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি, বৈদেশিক আক্রমণ, শিল্পবাণিজ্যের অবনতি প্রভৃতি মোগল অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছিল। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ফারুখশিয়রের ফরমান অনুযায়ী ইংরেজদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি দান এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলম কর্তৃক ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলা- বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি প্রদান মোগল সাম্রাজ্যকে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল করে তুলেছিল। এ প্রসঙ্গে স্যার যদুনাথ সরকার দ্বিতীয় শাহ আলমের ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেছেন।


জায়গির প্রথা: ইরফান হাবিবের মতে, ত্রুটিপূর্ণ জায়গিরদারি প্রথার প্রত্যক্ষ শিকার হয়েছিল কৃষকগণ। এই ব্যবস্থায় কৃষকদের উপর অত্যাচার ও শোষণ বেড়ে যায়, বহু কৃষক জমি ছেড়ে চলে যায়। জমিদার ও কৃষকরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। তাতে কৃষির ফলন হ্রাস পায়, যা ছিল সাম্রাজ্যের পক্ষে একটি অশুভ লক্ষণ। ঔরঙ্গজেবের আমলে জায়গির প্রথা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।


 ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব: ঔরঙ্গজেবের গোঁড়া ধর্মীয় নীতির ফলে অমুসলমানগণ, যেমন—জাঠ, বুন্দেলা, স্যামি, শিখ, রাজপুত ও মারাঠাগণ মোগলদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অধ্যাপক গৌতম ভদ্র দেখিয়েছেন যে, ঔরঙ্গজেবের আমলে সংগঠিত অধিকাংশ কৃষক বিদ্রোহের কারণ ছিল ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক। তিনি তাঁর জীবনের শেষ ২৫ বছর কেবল শিবাজি ও মারাঠাদের শায়েস্তা করতেই ব্যস্ত ছিলেন।


 মোগল শাসকদের দুর্বলতা: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যে পরবর্তী মোগল শাসকদের দুর্বলতা ও অপদার্থতার দরুন মোগল সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর ১২ বছরের মধ্যে সিংহাসনের দখল নিয়ে মুয়াজ্জম, মোহম্মদ ও আজমের মধ্যে তিন বার গৃহযুদ্ধ ও পাঁচ বার সম্রাট বদল হয়। বাহাদুর শাহের চার পুত্রের মধ্যেও বিরোধ বাধে।


 দরবারের রাজনীতি: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল দরবারে তিনটি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়, যথা— হিন্দুস্থানি, ইরানি ও তুরানি। বাহাদুর শাহের দরবারে জুলফিকার খান ছিলেন প্রভাবশালী ইরানি নেতা। হিন্দুস্থানি গোষ্ঠীর নেতা হুসেন আলি ও আবদুল্লা খান নামক সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিলেন দিল্লির দরবারে রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রা।


 বৈদেশিক আক্রমণ: মোগল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা আরও একট হয় দুটি বৈদেশিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের নাদির শাহ এবং ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে আফগান অধিপতি আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণ মোগল রাজশক্তির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।


 মূল্যায়ন: সুতরাং সামগ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় কোনো একটি বিশেষ কারণকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করা যায় না। বিভিন্ন কারণের সম্মিলিত ফসল ছিল মোগল সাম্রাজ্যের পতন।


2.  মোগলযুগে জায়গিরদারি সংকটের কারণ কী ছিল ? এর ফল কী হয়েছিল ?

 উত্তর:- একসময় যে জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থা ছিল মোগল শাসনব্যবস্থা ও সংহতির মূল ভিত্তি তা ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মোগল সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে তোে


মোগল যুগে জায়গিরদারি সংকটের কারণ

1) আয়ের ঘাটতি:-  মুঘল যুগের অধিকাংশ মনসবদার নগদে বেতন ভোগ করতেন তবে জায়গীর উদাহরণ ব্যতিক্রম ছিল না। এই প্রথার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল জমা ও হাসিল। কৃষি ফসল থেকে ও জমি থেকে কী পরিমাণে রাজস্ব সংগৃহীত হবে তার হিসাবকে বলা হত জমা এবং এই রাজস্ব বাবল আসায়িকৃত অর্থকে বলা হত হাসিল। জাহাঙ্গির ও ঔরকাজেনের রাজত্বকালে জায়গিরদারের সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু কৃষি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি। জাহাঙ্গিরের আমলে হাসিলের পরিমাণ দারুণভাবে হ্রাস পায়। সাম্রাজ্যের আয়ের উৎস কমে যেতে থাকে, ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে মনসবদারদের বেতন ও সৈন্যবাহিনীর বেতন দেওয়া এবং প্রশাসনিক খাতে টাকার জোগান দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।


 যথেচ্ছ জায়গির দান:  জায়গির লাভের আশায় শুরু হয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও দলাদলি। শাজাহানের সময় প্রায় সাত হাজার জন মনসবদার ছিলেন। ঔরঙ্গজেবের আমলে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৪.৪৪১ জন। দক্ষিণ ভারতের অভিজাতদের সমর্থন লাভের আশায় ঔরঙ্গজেব সেখানে বহু মনসব দান করেছিলেন।


 জায়গিরদারদের দুর্নীতির :- অধিক আয়ের লোভে কৃষকদের কাছ থেকে অত্যধিক পরিমাণ রাজস্ব আদায় করত। যদিও এই অতিরিক্ত হাসিল সরকারের তহবিলে জমা পড়ত না। প্রজাগণও চরম দুর্দশার মধ্যে পড়তে থাকে। তাদের জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে অসহনীয়। এ ছাড়া জায়গিরদারগণ অনেক সময় জায়গির ইজারা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে।


 দুর্নীতির সূচনা :- জায়গির লাভকে কেন্দ্র করে মনসবদারদের মধ্যে দুর্নীর্তি চরমে পৌঁছায়। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে জায়গিরদারদের মধ্যে এই রেষারেষি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে।


উৎপাদন হ্রাস:-  জায়গিরদাররা ব্যবসায়ী ও মহাজনদের জায়গির ইজারা দেওয়ার ফলে অধিক মুনাফার আশাষ কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালাত। ফলে কৃষকরা কৃষিকাজ ত্যাগ করলে উৎপাদন কমে যায়।


 সামরিক শক্তিহীনতা- জায়গিরগুলির আয় কম হওয়ায় মনসবদাররা নির্দিষ্ট সংখ্যক অশ্ব রাখত না। ফলে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মনসবদারদের থেকে সামরিক সাহায্য পেত না। ক্রমে সামরিক বাহিনী শক্তিহীন হয়ে পড়ে।


ফলাফল: স্যার সৈয়দ নুরুল হাসান তাঁর জায়গিরদার ক্রাইসিস ইন মোগল ইন্ডিয়া গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মোগল সাম্রাজ্যের শেষের দিকে বিশেষত মুজিবের রাজত্বকালের শেষের দিকে জায়গিরদারি সংকট চরম আকার ধারণ করে। যার ফলাফল ছিল ভয়ংকর।


3.   আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান আলোচনা করো। অথবা, মোঘল যুগে বাংলায় কীভাবে স্বাধীন নবাবির সূচনা হয় তা আলোচনা করো।

উত্তর:- মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় পর্যন্ত বাংলা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি সুবা। কিন্তু তার মৃত্যুর পর বাংলায় স্বাধীন নবাবের সূচনা হয়।

 আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান:- 


ঔরঙ্গজেবের সময়: ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে সুবা-বাংলার (বাংলা, বিহার ও ওড়িশা) রাজস্ব আদায়ের জন্য সম্রাট ঔরাজের মুরশিদকুলি খানকে বাংলার দেওয়ান করে পাঠান। এই সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন আজিম-উস-শান।


 ফারুখশিয়রের সময়: মোগল সম্রাট ফারুখশিয়র ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুরশিদকুলি খানকে বাংলার সুবেদার, দেওয়ান ও নাজিম পদে উন্নীত করেন। ফলে বাংলার প্রায় সব ক্ষমতাই তাঁর হাতে চলে যায়। অন্যদিকে বাংলার ক্ষমতাবান জমিদাররাও তাঁকে সহযোগিতা করেন।

এই সময় থেকেই তিনি দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বাংলায় স্বাধীন নবাবির সূচনা করেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি স্বমহিমায় বাংলার নবাব ছিলেন।


 ফারুখশিয়রের পর: ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ফারুখশিয়র ও বাংলার নবাব মুরশিদকুলি খানের মৃত্যু হয়। এরপর বাংলায় ক্রমান্বয়ে নবাব হন সুজাউদদিন, সরফরাজ খান, আলিবর্দি খান ও সিরাজ-উদদৌলা। এঁরা সকলেই দিল্লির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন।


মন্তব্য: এইভাবে মোগল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। মুরশিদকুলি খান বাংলায় যে স্বাধীন নবাবির সূচনা করেছিলেন। তা অব্যাহত ছিল সিরাজ-উদদৌলার রাজত্বকাল পর্যন্ত।


4.  মুরশিদকুলি খান থেকে আলিবর্দি খানের সময় পর্যন্ত বাংলার নবাবদের সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক আলোচনা করো।


উত্তর:-  বাংলার উন্নত ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় ইংরেজ কোম্পানি। কিন্তু বাংলায় বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় বাংলার নবাবগণ। স্বভাবতই কোম্পানির তা বাংলার নবাবদের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়নি।


বাংলার নবাব ও ইংরেজ কোম্পানি:

 মুরশিদকুলি খান: ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুরদিকুলি বাংলায় স্বাধীনভাবে নবাবি শাসন শুরু করেন। তিনি ছিলেন এ কজন বিচক্ষণ নবাব। তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজরা এখানে বাণিজ্য করুক, তবে বিনাশুল্কে নয়। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি কোম্পানির কাছ থেকে শুল্ক আদায় শুরু করেন। কিন্তু তাতে লাভ হত না। এ জন্য ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার জন্য একটি ফরমান আদায় করে নেয় সেই ফরমানের জোরেই কোম্পানি বাংলায় বিনাশুলকে বাণিজ্য শুরু করে।

 সম্পর্কের অবনতি: বাংলায় বাণিজ্য করার ফরমান লাভ প্রসঙ্গে মুরশিদকুলি খান মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। স্বভাবতই তাঁর সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি হয়। দস্তকের জোরে কোম্পানির বণিকেরা বাংলায় ব্যক্তিগত বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিল। এতে যেমন ক্ষতি হচ্ছিল বাংলার বণিককুলের; তেমনি ক্ষতি হচ্ছিল নবাবের অর্থনৈতিক স্বার্থ। কারণ কোম্পানি ও তার বণিকেরা বিনাশুল্কে অর্থাৎ, কর ফাঁকি দিয়ে বাংলায় ব্যাবসাবাণিজ চালিয়ে যেতে থাকে। মুরশিদকুলি খান ইংরেজদের এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং, এর ফলে নবাব প্রতি বছর এক বিশাল অঙ্কের টাকা থেকে বঞ্চিত হয়। তবে মুরশিদকুলি খান বাংলার স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ইংরেজদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের রাস্তায় যাননি। বরং নিমরাজি হয়েই তা মেনে নেন।


 সুজাউদ্দিন খান : পরবর্তীকালে বাংলার নবাব সুজাউদ্‌দিন নবাব মুরশিদকুলি খানের অনুসৃত নীতিই অনুসরণ করেন।১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে মুরশিদকুলি খানের জামাতা সুজাউদ্‌দিন বাংলার নবাব হন। তিনিও ইংরেজদের বিনাশুল্কে ব্যাবসাবাণিজ্য বিষয়ে ক্ষুদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রায়ই কোম্পানির বণিকদের আটক করে হয়রানি করতেন। লবণ আটক করে কোম্পানির বণিকদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতেন।


আলিবর্দি খান: ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদে বসেন নবাব আলিবর্দি খান। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় তাদের বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা থেকে বিশেষ বঞ্চিত করেননি। কারণ তিনি জানতেন বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রশ্নে ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রয়োজন আছে। তবে তিনি কোম্পানির রাজনৈতিক ও সামরিক বাড়বাড়ন্তের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। নবাবের কর্মচারীগণ মাঝে মধ্যেই কোম্পানির বণিকদের ব্যাবসা বাণিজে বাধা সৃষ্টি করত এবং অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করত।


ইতিমধ্যে দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকের যুদ্ধ বা ইঙ্গ-ফরাসি সংঘর্ষ বাঁধলে ইংরেজ ও ফরাসিগণ কলকাতা ও চন্দননগরে দুর্গ নির্মাণ করতে তৎপর হয়। উভয়েই নবাবের কাছে দুর্গ নির্মাণের অনুমতি চাইলে, তিনি তা নাকচ করে দেন।


• মন্তব্য: এইভাবে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে বাংলার নবাবদের একটা অম্ল মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে সিরাজ উদদৌলার সময় সেই সম্পর্ক তিক্ততার স্তরে পৌঁছোয়।


5.  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাংলার নবাব সিরাজ-উদদৌলার বিরোধের কারণগুলি আলোচনা করো। 


উত্তর:-  ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদে বসেন সিরাজ-উদ্দৌলা। এই ঘটনা আলিবদ্দির কিছু আত্মীয়-বর্গ এবং সভা সদরা মেনে নিতে পারেনি তারা সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন । এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিন ঘসিটি বেগম, জগত শেঠ উর্মি চাঁদ, রায়দুল্লাভ, শওকত জঙ্গ, মির্জাফোর প্রমুখ সবশেষে ইংরেজ কোম্পানি এই ষড়যন্ত্রে যোগ দিলে সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে।

ঘসেটি বেগমকে সাহায্য:  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ঘসেটি বেগম ও পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ কে সিরাজ বিরোধী কাজে সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই সংবাদ নবাবের কর্ণগোচর হলে তিনি ইংরেজদের প্রতি রুষ্ট হন।

 দুর্গ নির্মাণ: দাক্ষিণাত্যে কর্ণাটকের যুদ্ধ শুরু হলে ইংরেজরা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ ও দুর্গ সংস্কারের কাজ শুরু করে। সিরাজ ইংরেজদের দুর্গ সংস্কার করতে বারণ করেন। কিন্তু সেই নিষেধ অমান্য করে কোম্পানি দুর্গ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যায়।


 কৃয়দাসকে আশ্রয় দান: ঢাকার শাসক নওয়াজিস মোহম্মদের মৃত্যু হলে তাঁর দেওয়ান রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে ইংরেজদের শরণাপন্ন হয়। সিরাজ কৃষ্ণদাস কে তাঁর হাতে তুলে দিতে আদেশ দিলে কলকাতার ইংরেজ গভর্নর ড্রেক তা অস্বীকার করেন।

দস্তকের অপব্যবহার: সিরাজের নির্দেশ অমান্য করেকোম্পানির বণিকরা ব্যক্তিগতভাবে দস্তকের অপব্যবহার শুরু করে। তাতে নবাবের শুল্ক বাবদ আয় দারুণ ভাবে হ্রাস পায়। 

 সিরাজকে অপমান: প্রথা অনুযায়ী ইংরেজ কোম্পানি বাংলার নতুন নবাব সিরাজ-উদদৌলাকে কোনো উপঢৌকন বা নজরানা পাঠিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেনি। ইংরেজদের এই উদ্ধত আচরণে সিরাজ দারুণ অপমানিত বোধ করেন।


6. তুমি কি মনে করো সিরাজ উদদৌলা ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল ?


উত্তর:-  নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজ- উদদৌলা বাংলার নতুন নবাব হন। নবাব হওয়ার কিছুদিন পরেই একের পর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানির বিরোধ তৈরি হয়।


সংঘর্ষের কারণ


 নজরানা না দেওয়া: ব্রিটিশ কোম্পানি সিরাজের ক্ষমতা লাভকে সুনজরে দেখেনি। সেইজন্য প্রথা অনুযায়ী নবাবের কাছে কোম্পানি কোনো নজরানা বা উপঢৌকন পাঠায়নি। এর ফলে সিরাজ কোম্পানির প্রতি ক্ষুদ্ধ হন।


 দস্তকের অপব্যবহার:-  কোম্পানি বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার জন্য দস্তক নামে যে পরোয়ানা লাভ করেছিল তার অপব্যবহার করে। কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তক ব্যবহার করতে থাকলে বাদশাহি শুল্কের ক্ষতি হয়। নবাব ও কোম্পানির মধ্যে এই শুল্ক নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল।


কলকাতায় দুর্গসংস্কার: ফরাসি ও ব্রিটিশ কোম্পানি বাণিজ্যিক স্বার্থে নিজের নিজের দুর্গ সংস্কারে লিপ্ত হলে সিরাজ উভয় কোম্পানিকে এই কাজে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ফরাসিরা নবাবের নির্দেশ মেনে নিলেও ব্রিটিশ কোম্পানি দুর্গ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যায়। এর ফলে সিরাজ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।


স্ত্রী নবাবের অকৃতজ্ঞ কর্মচারীকে আশ্রয়:-  বাংলার কোষাগার তছরূপে অভিযুক্ত কৃষ্ণদাস নামে এক কর্মচারীকে কোম্পানি কলকাতায় আশ্রয় দেয়। তাকে সিরাজ ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলে কোম্পানি অগ্রাহ্য করে। ফলে কোম্পানির প্রতি সিরাজ-উদদৌলা রুষ্ট হন। আমার মনে হয়, এইসকল কারণে সিরাজ উদদৌলা ও ব্রিটিশ কোম্পানির মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। 


7. 'অন্ধকূপ হত্যা' বলতে কী বোঝায় ?


উত্তর:-  পটভূমি: কলকাতার ইংরেজ গভর্নর ড্রেক নানাভাবে নবাব সিরাজ-উদদৌলার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে। সিরাজের নির্দেশ সত্ত্বেও ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে যেমন তিনি প্রত্যর্পণ করেননি, তেমনি ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গের সংস্কার কাজও তিনি বন্ধ করেননি। ডেকের এই উদ্ধত আচরনে ক্রুদ্ধ সিরাজ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে কলকাতা অভিযান করেন। ৪ জুন সিরাজ ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠি দখল করেন। এরপর ১৬ জুন (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ) তিনি কলকাতা পৌঁছোন। তিনদিন পর গভর্নর ড্রেক, সেনাবাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ইংরেজরা দুর্গ ছেড়ে ফলতায় পালিয়ে যান। পরের দিন (২০ জুন) ফোর্ট উইলিয়ামের সেনারা সামান্য প্রতিরোধের পর আত্মসমর্পণ করে।


হল ওয়েল-এর বিবরণ: হলওয়েল নামে জনৈক ব্রিটিশ কর্মচারী এক বিবরণে জানান যে, এই সময় সিরাজ ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে একটি ১৮×১৮ ঘরের মধ্যে আটকে রাখেন। পরের দিন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এর মধ্যে ১২৩ জন মারা যান। ইংরেজ ঐতিহাসিক হলওয়েলের মতে পরিকল্পিতভাবে সিরাজ ইংরেজদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। এই ঘটনা অন্ধকূপ হত্যা (Black Tragedy) নামে পরিচিত।


সমালোচনা: অ্যানি বেসান্ত বলেছেন, হলওয়েল যে ঘরের পরিমাপের কথা বলেছেন তা 'পাটিগণিত ও জ্যামিতির নিয়মে মিথ্যা' বলে প্রমাণিত হয়। কারণ মা ১৪৬ জন লোককে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব না। ড. যদুলাল সরকার বলেন, তখন কলকাতায় ১৪৬ জন ইংরেজ ছিল না। ৬০/৬৫ জন ইংরেজ থাকতে পারে। ঐতিহাসিক হলওয়েল কিন্তু সিরাজকেই এজন্য দাবী করেছেন। যাইহোক, কলকাতা আক্রমণের কথা শুনে রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে কলকাতা আসেন এবং ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি কলকাতা পুনর্দখল করেন। সিরাজ শেষ পর্যন্ত ৯ ফেব্রুয়ারি আলিনগরের অপমানজনক সন্ধির শর্ত মেনে নেন এবং এই সন্ধির ফলে দত্তকের ব্যবহার ও দুর্গনির্মাণের অনুমতি দিতে সিরাজ বাধ্য হন।


 ৪.  পলাশির যুদ্ধ কি ভারতে ব্রিটিশদের ক্ষমতালাভে সাহায্য করেছিল ? অথবা, পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা করো।


উত্তর:-  ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ কোম্পানির বাহিনী নবাব সিরাজউদদৌলার বাহিনীকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।  পলাশির যুদ্ধের গুরুত্ব:- 


 1) এই যুদ্ধের ফলে বাংলার নবাবের রাজনীতি জ্ঞানের অভাব ও সামরিক দক্ষতার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। (2) এই যুদ্ধে প্রথম ইউরোপীয় শক্তি তথা ব্রিটিশ কোম্পানি দেশীয় শক্তি অর্থাৎ বাংলার নবাবকে পরাজিত করে।ফলে ব্রিটিশদের সামরিক প্রাধান্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। 3)পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ব্রিটিশ কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সুসংহত হয়েছিল।


4) এই যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটিশ কোম্পানি প্রচুর অর্থলাভে করে এবং পরবর্তীকালে সেই অর্থে সৈন্যবাহিনী বৃদ্ধি করে ভারত বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে।


5)  পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ ইউরোপের অন্যান্য শক্তি, বিশেষত ফরাসিদের ভীত করে তোলে এবং পরবর্তী সময়ে তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধে তারা মনোবল হারিয়ে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়।


9.  পলাশির যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করো।


উত্তর:-  ভূমিকা: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার নবাব সিরাজউদদৌলা পরাজিত হন। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই যুদ্ধের ফলাফল অপরিসীম।


পলাশির ফলাফল:-  সামরিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে, এই ছিল নিছক একটা অসম খণ্ডযুদ্ধ। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনৈি বিচারের নিরিখে পলাশির যুদ্ধ ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।


রাজনৈতিক:  ১)এই যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদদৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন। ফলে বাংলায় স্বাধীন নবাবির অবসান ঘটে। (২) গোপন চুক্তি অনুসারে বাংলার মসনদে বসেন মিরজাফর। ৩) তিনি কোম্পানির ক্রীড়নকে পরিণত হন। এই সময় থেকে বাংলার শাসনক্ষমতা পরোক্ষভাবে কোম্পানির হস্তগত হয়। ৪) ধীরে ধীরে বাংলাকে কেন্দ্র করেই ইংরেজরা সারা ভারতে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।৫) ইংরেজর পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করার পর বাংলা থেকে ফরাসি বণিকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।


 অর্থনৈতিক: পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ কোম্পানি বাংলাদেশে অবাধে বাণিজ্য শুরু করে।

 a) কোম্পানি ও তার বণিকরা দস্তকের অপব্যবহার শুরু করে। b) কোম্পানি বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার ফলে দেশীয় বণিককুল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । d)  কোম্পানির একাধিপত্যের দরুন বাংলার শিল্প, কৃষি তথা বাণিজ্যে দেখা দেয় ভয়াবহ শূন্যতা। পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী বাংলার ইতিহাস হল কোম্পানির অর্থনৈতিক শোষণের ইতিহাস। ইংরেজরা এদেশের অর্থ ও সম্পদ বিনা বাধায় ইংল্যান্ডে চালান শুরু করে। ব্রুক্স অ্যাডামস এই অধ্যায়কে বলেছেন 'পলাশির লুণ্ঠন'। স্যার যদুনাথ সরকারের মতে, পলাশির যুদ্ধের ফলে ভারতে মধ্যযুগের অবসান হয় এবং আধুনিকযুগের সূচনা হয় ।


প্রশ্ন 10


টীকা লেখো : পলাশির লুণ্ঠন।


উত্তর:-  পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা দু-হাত ভরে বাংলার অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং সেই অর্থ ইংল্যান্ডে অবাধে পাচার করে দেয়। ইংরেজ কোম্পানির এই অর্থনৈতিক শোষণকে ব্রুক্স অ্যাডামস 'পলাশির লুন্ঠন' বলে অভিহিত করেন।


 পলাশির লুন্ঠনের বিবরণ


i) পুরস্কারস্বরূপ: বাংলার নবাব হওয়ার পূর্ব শর্ত অনুযায়ী এই খাতে মিরজাফর প্রায় ১.৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছিলেন। মিরজাফর ক্লাইভ সহ কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীদের পুরস্কারস্বরূপ প্রচুর অর্থ প্রদান করেন। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভে এর পর ক্লাইভ মিরজাফরের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা লাভ করেন।

নবাব কেনাবেচা:-  ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মিরজাফরকে সরিয়ে কোম্পানি মিরকাশিমকে বাংলার নবাব করেন। @ এই সূত্রে কলকাতার ইংরেজ আধিকারিকরা লাভ করেন প্রায় ২৯ লক্ষ টাকা। (B) এরপর নজম-উদদৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে কলকাতার উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীরা পান প্রায় ৬২,৫০,০০০ টাকা।


৪) বাণিজ্য মারফত: পলাশির যুদ্ধে জয়লাভ করে  কোম্পানির ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। একদিকে কোম্পানি বাংলায় একচেটিয়া বাণিজ্য করে ফুলে ফেঁপে ওঠে। অন্যদিকে কোম্পানির বণিকরা ব্যক্তিগতভাবে বাণিজ্য শুরু করে।


অন্যান্য বাবদ :- সিরাজের কলিকাতা আক্রমণ ও পলাশির যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ইংরেজ কোম্পানি মিরজাফরের নিকট ১,৭৭,০০,০০০ টাকা আদায় করে।


 মন্তব্য: এইভাবে ইংরেজ কোম্পানি, তার বণিক ও কর্মচারীরা বাংলার অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং তার প্রায় সবটাই বিলেতে পাচার করে দেয়। তাই ঐতিহাসিক পি জে মার্শাল পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী অধ্যায়কে কোম্পানি কর্তৃক সম্পদ নির্গমনের নির্লজ্জ অধ্যায়' বলে চিহ্নিত করেছেন।


11.  ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে নবাব মিরকাশিমের বিরোধের কারণ কী? অথবা, বক্সারের যুদ্ধের কারণ উল্লেখ করো ।


উত্তর:-  নানা কারণে নবাব মিরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর সেই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত রূপ ছিল। বক্সারের যুদ্ধ।


• বক্সারের যুদ্ধের কারণ


 অর্থনৈতিক দিক:- i) মিরকাশিম তাঁর অর্থবল মজবুত করার জন্য কতগুলি আর্থিক সংস্কার করেন, যেমন— জমিদারদের উপর বাড়তি করের বোঝা চাপানো হয়। দুর্নীতিগস্ত কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হয় এবং তাঁদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় করা হয়। শেঠ পরিবারের কাছ থেকে আবওয়াব নামক অতিরিক্ত কর আদায় করা হয় এবং তাদের কাছ থেকে জোর করে ঋণ নেওয়া হয়।


(ii) সামরিক বিষয়: নবাব তাঁর সামরিক বাহিনী মজবুত করতে মুােরে কামান ও বারুদের কারখানা স্থাপন করেন। সেনাবাহিনীকে সুশিক্ষিত করে তোতাপ থেকে মার্কার ও সমরু নামক দুজন দক্ষ সেনা প্রশিক্ষক নিয়ে আসেন।


(iii) প্রত্যক্ষ কারণ: ইংরেজ কোম্পানি ও বণিকরা দস্তবের অপব্যবহার শুরু করে। এতে নবাব তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। ভারতীয় বণিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এই অবস্থায় মিরকাশিম বছরে ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিকট একটি বাদশাহি ফরমান আদায় করেন এবং দেশীয় বণিকদের ওপর থেকে বাণিজ্য তুলে নেন। এতে ইংরেজরা দারুণ হয়। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

যুদ্ধের সূচনা :- এই সংঘর্ষে মিরকাশিম ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে কোটোয়া, মুরশিদাবাদ, গিরিয়া, উদয়নালা ও মুঙ্গের) পরাজিত হন। শেষপর্যন্ত তিনি অযোধ্যার নবাব ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে মিত্রতা জোট গড়ে তোলেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। এইভাবে ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় বক্সারের যুদ্ধ ।


12. বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব বা তাৎপর্য নির্ণয় করো।


উত্তর:-  ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব মিরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদদৌলা ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির বক্সারের যুদ্ধ হয়। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই যুদ্ধ এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।


বক্সারের যুদ্ধের তাৎপর্য i) প্রত্যক্ষ ফল: বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির কাছে বাংলার নবাব মিরকাশিম পরাজিত হন। ফলে বাংলার স্বাধীন নবাবির শেষ প্রদীপটুকু নিভে যায়।


(ii) রাজনৈতিক গুরুত্ব :-  বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় প্রকৃত ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। iii) বক্সারের যুদ্ধে একযোগে তিন শক্তিকে পরাজিত করে ইংরেজ কোম্পানির রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। iv)ইংরেজদের আধিপত্য বাংলার সীমানা অতিক্রম করে সুদূর এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

 দেওয়ানি লাভ: বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির সূত্র ধরেই কোম্পানি সুবা-বাংলায় দেওয়ানি লাভ করে।


 বাণিজ্যিক গুৰুত্ব ১) ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি বাংলায় রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। (২) অন্যদিকে তাদের বাংলার মাটিতে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।


মন্তব্য: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই যুদ্ধের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করেন, যার ভয়ঙ্কর ফলশ্রুতি ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।



No comments:

Post a Comment

'; (function() { var dsq = document.createElement('script'); dsq.type = 'text/javascript'; dsq.async = true; dsq.src = '//' + disqus_shortname + '.disqus.com/embed.js'; (document.getElementsByTagName('head')[0] || document.getElementsByTagName('body')[0]).appendChild(dsq); })();