দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তারপর নবম শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায়| class 9 history 6th chapter questions answers|
প্রশ্নের মান- ০১
১. মিউনিখ চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়?
Ans. ১৯৩৮ সালে।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয়?
Ans. ১৯৩৯ সালে।
৩. "ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি নীতি" কোন দেশ গ্রহণ করেছিল?
Ans. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
৪. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?
Ans. হিদেকি তেজো।
৫. আটলান্টিক সনদ কবে স্বাক্ষরিত হয়?
Ans. ১৯৪১ সালে।
৬. তোষণ নীতির উদ্ভাবক কে ছিলেন?
Ans. নেভিল চেম্বারলেন।
৭. ফুলটন বক্তৃতা কে দেন?
Ans. চার্চিল।
৮. রুশ-জার্মান-অনাক্রমন চুক্তি কবে স্বাক্ষরিত হয়?
Ans. ১৯৩৯ সালে।
৯. হিটলার কবে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন?
Ans. ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর।
১০. কোন দিনটি D Day বা মুক্তি দিবস নামে পরিচিত?
Ans. ১৯৪৪ সালের ৬ জুন।
১১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা জাপানের কোন দুটি শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল?
Ans. হিরোশিমা ও নাগাসাকি।
১২. NATO কথার অর্থ কী?
Ans. North Atlantic Treaty Organization।
১৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন?
Ans. রুজভেল্ট।
১৪. পটসডাম সম্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয়?
Ans. ১৯৪৫ সালে।
প্রশ্নের মান- ০২
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্ব কোন্ দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে?
Ans. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্ব যে দুটি পরস্পর-বিরোধী জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেগুলি হল— [1] ইটালি, জার্মানি ও জাপানকে নিয়ে গড়ে ওঠে ‘অক্ষশক্তি’, [2] ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও সোভিয়েত রাশিয়াকে নিয়ে গড়ে ওঠে ‘মিত্রশক্তি'।
২. ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির ‘তোষণনীতি’ বলতে কী বোঝ?
Ans. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইটালির মুসোলিনি এবং জার্মানির হিটলার আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করে বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করলেও ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি তা প্রতিরোধের কোনো সক্রিয় উদ্যোগ না নিয়ে ইটালি ও জার্মানির প্রতি উদাসীন নীতি গ্রহণ করে। এটি তোষণনীতি নামে পরিচিত।
৩. “ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি” নীতি কী?
Ans. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু ফ্রান্সের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় নীতি পরিবর্তন করে বিশ্বের গণতন্ত্রী দেশগুলিকে সাহায্য করার নীতি গ্রহণ করে এবং ক্যাশ এ্যান্ড ক্যারি’ (“Cash and carry”) নীতি চালু করে। অর্থের বিনিময়ে গণতন্ত্রী দেশগুলিকে যুদ্ধাস্ত্র জোগান দেওয়াই ছিল এই নীতির মূল কথা।
৪. আটলান্টিক চার্টার কী?
উত্তর : ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলযুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্য সম্বলিত এক দলিল ঘোষণা করেন। এই দলিল আটলান্টিক চার্টার নামে পরিচিত।
৫. ‘ডি-ডে’ বা ‘মুক্তি দিবস’ সম্পর্কে কী জান?
Ans. মিত্রপক্ষের চার হাজারেরও বেশি সংখ্যক জাহাজে দেড় লক্ষেরও বেশি সংখ্যক সেনা ১৯৪৪ খ্রিস্ট্রাব্দের ৬ জুন ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ফ্রান্সের নর্মান্ডি উপকূলে অবতরণ করে এবং জার্মানির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এই দিনটি ‘ডি-ডে (Deliverance Day) বা ‘মুক্তি দিবস’ নামে পরিচিত।
৬. ‘পার্ল হারবার’ ঘটনা কী?
Ans. উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ঘাঁটি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনা ‘পার্ল হারবার’ ঘটনা নামে পরিচিত।
৭. ঠান্ডা লড়াই কাকে বলে?
Ans. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পুঁজিবাদী জোট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাম্যবাদী জোট সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে যে পারস্পরিক রেষারেষি ও বিদ্বেষপূর্ন মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত।
৮. ‘ফুলটন বক্তৃতা’ বা ‘লৌহ যবনিকা তত্ত্ব’ কী ?
Ans. ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার মিসোরি প্রদেশের ফুলটনে ওয়েস্ট মিনিস্টার কলেজে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় ইউরোপে রুশ প্রভাব বিস্তারের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আমেরিকাবাসীকে সচেতন করে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তার এই বক্তৃতা ‘ফুলটন বক্তৃতা’ নামে পরিচিত।
৯. ফ্যাসিবাদী আদর্শ বলতে কী বােঝাে?
উত্তর: ফ্যাসিবাদী আদর্শ বলতে বােঝায় এক ধরনের উগ্র\ জাতীয়তাবাদী, জাতিবিদ্বেষী, আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একদলীয়, একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা এবং এক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী মতবাদকে।
১০. ওয়াল ওয়াল ঘটনা' কী ?
উত্তর: ওয়াল ওয়াল হল আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত আবিসিনিয়ার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। তার পাশে সােমালিল্যান্ড ইটালির অধিকারে ছিল। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর সােমালিল্যান্ড ও আবিসিনিয়ার সীমান্তে অবস্থিত ওয়াল ওয়াল গ্রামে দুপক্ষের সেনাবাহিনীর মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ হয়। এই ঘটনাকে 'ওয়াল ওয়াল ঘটনা’ বলা হয়। এই ঘটনার অজুহাতে হিটলার আবিসিনিয়ার সম্রাট হেইলে সেলাসিকে চরমপত্র দেন এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইটালি আবিসিনিয়া দখল করে নেয়।
১১. আনসুজ’ কী?
উত্তর : হিটলারের বিদেশনীতির অন্যতম নীতি ছিল আনফ্লুজ নীতি ইউরােপে বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী জার্মানদের জাতীয়তাবাদের স্বার্থে একত্রিত করার ক্ষেত্রে হিটলারের গৃহীত নীতি আনসুজ’ নামে পরিচিত। হিটলার জার্মান জাতির ঐক্যস্থাপনের উদ্দেশ্যে অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সাথে যুক্ত করার জন্য আনফ্লুজ নীতি গ্রহণ করেছিলেন(১৯৩৮ খ্রি.)।
১২. ইস্পাতের চুক্তি’ (Steel Pact) কবে, কাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ?
উত্তর: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার জার্মানির কূটনৈতিক অবস্থান। সুদৃঢ় করতে অগ্রসর হন। তিনি উপলব্ধি করেন পােল্যান্ডের সঙ্গে ইঙ্গ-ফরাসি সম্পর্ক স্থির বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। চাপ সৃষ্টি করে পােল্যান্ডকে নিয়ে নতুন বােঝাপড়া অসম্ভব। তাই জার্মানি ও ইটালির মধ্যে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ‘ইস্পাতের চুক্তি’ (Steel Pact)স্বাক্ষরিত হয়।
১৩. আশ্চর্যজনক নিষ্কৃতি' (a miracle of deliverance)কী ?
উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি হিটলারের আক্রমণের চাপে প্রায় ৩ লক্ষ ইঙ্গ-ফরাসি সেনা ফ্রান্সের ডানকার্ক বন্দরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মিত্রপক্ষের এক বিশাল নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রহরায় এই অবরুদ্ধ সেনাদলকে নিরাপদে ইংলিশ চ্যানেল পার করে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে আনা হয়। এই ঘটনাকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আশ্চর্যজনক নিষ্কৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন।
১৪. অপারেশন বারবারোসা’ কী ?
উত্তর: হিটলারের রাশিয়া অভিযানের (১৯৪১ খ্রি.) সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন বারবারােসা’। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী বিশাল সেনাবাহিনী এবং শক্তিশালী থল ও বিমানবাহিনীর সাহায্যে এই রাশিয়া অভিযান তথা ‘অপারেশন বারবারােসা’ শুরু করেন।
১৫. হিটলার কেন পােল্যান্ড আক্রমণ করেন?
উত্তর: মিউনিখ চুক্তি (১৯৩৮ খ্রি.) স্বাক্ষরের পর হিটলার ডানজিগ বন্দর ব্যবহার এবং সেখানে পৌছােনাের জন্য পােল্যান্ডের কাছে একটি করিডর (পােলিশ করিডর) দাবি করেন। পােল্যান্ড সেই দাবি পূরণে অসম্মত হয় বলে হিটলার ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর পােল্যান্ড আক্রমণ করেন।
১৬. শ্বেত অভিযান' কী?
উত্তর: হিটলার ডানজিগ বন্দরে পৌছােনার জন্য পােল্যান্ডের মধ্য দিয়ে একটি সংযােগকারী পথ (পােলিশ করিডর) দাবি করেন। কিন্তু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পােল্যান্ডের পাশে থাকার আশ্বাস দিলে পােল্যান্ড হিটলারের দাবি মানতে অস্বীকার করে। এর ফলে ক্ষুদ্ধ হিটলার পােল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে অভিযান করেছিলেন সেটাই শ্বেত অভিযান(Operation White) নামে পরিচিত।
১৭. ভূতুড়ে যুদ্ধ' বা 'Phony War' বা ‘টেলিফোনে যুদ্ধ কী ?
উত্তর:- ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে জার্মান কর্তৃক পােল্যান্ড আক্রমণের সময় থেকে ফ্রান্স আক্রমণ পর্যন্ত সময়ে (মে, ১৯৪০ খ্রি.) ইঙ্গ-ফরাসি মিত্রশক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলেও
প্রকৃতপক্ষে তারা কোনাে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। এই কারণে এই সময়কালের যুদ্ধকে উইনস্টন চার্চিল ভূতুড়ে যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
১৮.তােষণনীতি' বলতে কী বােঝাে?
উওর: জার্মানির একনায়কতন্ত্রী নেতা হিটলারের নানাবিধ শান্তি বিঘ্নকারী কাজকর্মে বাধা প্রদান না করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাকে সন্তুষ্ট করার যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা তােষণনীতি নামে পরিচিত। ইংল্যান্ড
ও ফ্রান্সের কাছে নাৎসিবাদ অপেক্ষা সমাজতন্ত্রবাদই বেশি বিপজ্জনক বলে প্রতিপন্ন হয়েছিল। হিটলার ছিলেন সাম্যবাদের প্রধান শত্রু। তাই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স হিটলারের মাধ্যমে সাম্যবাদকে রােধ করতে চেয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে হিটলারের সাহস বৃদ্ধি পায় ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
১৯.দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?
উত্তর:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল হিটলারের পােল্যান্ড আক্রমণ।হিটলার ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর পােল্যান্ডের ডানজি বন্দর ও পােলিশ করিডরের দাবিতে পােল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
২০. হিটলার কেন রাশিয়া আক্রমণ করেন।
উত্তর:- ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রাশিয়া আক্রমণ হিটলারের
পূর্বদিকে বিস্তারনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়াও রাশিয়া কর্তৃক জার্মানির আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা, ইউক্রেনের গমের খেত ও বাকুর গেট্রোলিয়াম খনিগুলি হস্তগত করার চেষ্টা, দার্দানেলিস প্রণালীর উপর বুশ নৌ-আধিপত্য রােধের প্রচেষ্টা ইত্যাদি নানান কারণে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন।
২১. লেড লিজ আইন কী ?
উত্তর:- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বুজভেল্ট মার্কিন সিনেট-এ এক আইন পাস করেন। এতে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তিবর্গকে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজসহ বিভিন্ন
যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আইন লেন্ড লিজ আইন’ নামে পরিচিত।
২২. কেন্নান নোট' কী ?
উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ কেন্নান সােভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরােধমূলক নীতি গ্রহণের জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরে এক দীর্ঘ টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন। এই টেলিগ্রাম কেন্নান নােট’ নামে পরিচিত।
২৩. বেষ্টনী নীতি (Policy of Containment) কী ?
উত্তর:- বেষ্টনী নীতির প্রবক্তা ছিলেন মার্কিন কূটনীতিবিদ জর্জ এফ কেন্নান। তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে Mr.X ছদ্মনামে ‘Foreign Affairs পত্রিকায় ‘সােভিয়েত কার্যকলাপের উৎস' নামে এক প্রবন্ধে সাম্যবাদের অগ্রগতি প্রতিহত করবার জন্য সােভিয়েত রাশিয়াকে তার দখলিকৃত অণ্ডলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলেন, এই নীতি পলিসি অফ কনটেইনমেন্ট বা বেষ্টনী নীতি' নামে পরিচিত।
২৪. পার্ল হারবার'ঘটনা কী ?
উত্তর:- প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ঘাঁটি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের৭ ডিসেম্বর জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনা ‘পার্ল হারবার’ ঘটনা নামে পরিচিত।
২৫. ডি ডে (D Day) বলতে কী বােঝায় ?
উত্তর:- ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে জার্মানির কাছে ফ্রান্স পরাজিত হয়।১৯ss খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন মিত্রপক্ষের সৈন্যবাহিনী ফ্রান্সের ন্যাভিতে অবতরণ করে। ফলে ফ্রান্সের ভুখন্ডে জার্মানবিরােধী অভিযান শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুরে ইতিহাসে এই দিনটি ডি ডে (Deliverance Day) বা মুক্তি দিবস’ নামে খ্যাত।
২৬. জাতীয়তাবাদ’ কাকে বলে?
উত্তর:- কোনাে নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী মানুষজনের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে যখন আপাত বিরােধগুলি ব্যতিরেকেবৃহত্তর স্বার্থে ও সার্বিকলক্ষ্যে এক গভীর ঐবােধ ও একাত্মবােধ গড়ে ওঠে, তখন তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে চেতনা জাগ্রত হয়, সেটাই হল জাতীয়তাবাদ’ (Nationalism)।
২৭. ঠান্ডা লড়াই কী ?
উত্তর:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ পরস্পরবিরােধী দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়, যার একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী জোট এবং অন্যদিকে ছিল সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোট। এই দুই শক্তিজোটের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধ না হলেও উভয়ের মধ্যে সর্বদাই একটি যুদ্ধের পরিবেশ বজায় থাকে, যা ঠান্ডা লড়াই’ (Cold War) নামে পরিচিত। আসলে ঠান্ডা লড়াই ছিল পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী জোটের আদর্শগত সংঘাত।
২৮. মার্শাল পরিকল্পনা' কী ?
উত্তর :- অর্থনৈতিক দুরবস্থার সুযােগে যাতে পশ্চিম ইউরােপে সাম্যবাদের প্রভাব বিস্তৃত না হয়, সে কারণে এই অঞলের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জর্জ সি মার্শাল ১৯৪৭
খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন মার্কিন সাহায্যের এক পরিকল্পনা ঘােষণা করেন তার এই প্রস্তাব ‘মার্শাল পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।
২৯. ন্যাটো' (NATO) কী ?
উত্তর:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সাম্যবাদী রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে তার অনুগামী রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এক সামরিক জোট গড়ে ওঠে, যা উত্তর
আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (North Atlantic Treaty Organisation) বা ন্যাটো (NATO) নামে পরিচিত। এই সংগঠনভুক্ত দেশগুলি হল— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা প্রভৃতি।
৩০.জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন' বলতে কী বােঝায়?
উত্তর:- স্বাধীনতা লাভের পর ভারত আমেরিকা ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কোনাে জোটশক্তিতে যােগ না দিয়ে উভয় গােষ্ঠীর সঙ্গে বন্ধুত্ব রা সমদূরত্ব বজায় রেখে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তার বিদেশনীতি পরিচালনার কথা ঘােষণা করে, যা ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন এই নীতির প্রধান প্রবক্তা ও রূপকার।
প্রশ্নের মান-4
1. তােষণনীতি কী? এই নীতি কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল?
উত্তর:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জার্মানির উপর ভার্সাই সন্ধির কঠোর শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি ভাসাই সন্ধির বিভিন্ন শর্ত ভঙ্গ করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সাম্যবাদ ভীতিতে আতঙ্কিত ছিল। তাই তারা হিটলারের বিভিন্ন কার্যকলাপ মেনে নেয়।
তােষণনীতি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নিজ নিজ নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্স কর্তৃক ইটালি, জার্মানি ও জাপানের আগ্রাসন নীতিকে সমর্থন করাকেই ‘তােষণনীতি' বলা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তােষণনীতি : নীচে তােষণনীতির কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল- প্রথমত, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বান্ডউইনের আমলে (১৯৩২-৩৭
খ্রিস্টাব্দ) ইজগ-জার্মান নৌ চুক্তির (১৯৩৫ খ্রি.) দ্বারা জার্মানিকে অসুসজ্জার এবং ব্রিটিশ নৌবহরের ৩৫% ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত : ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে লিগের নির্দেশ অমান্য করে আবিসিনিয়া আক্রমণকারী ইটালিকে ব্রিটেন নানাভাবে সাহায্য করে।
তৃতীয়ত : ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুত্বে ইটালি ও জার্মানির সাহায্যপ্রাপ্ত জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিদ্রোহে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজয় থাকে। চকু থত১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ চুক্তি দ্বারা সুদেতান এবং ১.৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলারের অস্ট্রিয়া ও চকোশ্লোভাকিয়া দখলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাহায্য প্রদান হিটলারকে পােল্যান্ড দখলের ইন জুগিয়ে। আবার অপরদিকে গােলাক জামনির হাত % ।
বাঁচানাের জন্য ইজ-২কসি প্রচেষাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ১% রহিল।ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, ব্রিটেন, ফ্রান্স এত বিগ| প্রথম থেকেই তােষণনীতির পরিবর্তে প্রতিরােধনীতি গড়ে তুন, তাহলে হয়তাে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এড়ানাে যেত।
২. টীকা লেখাে : আবিসিনিয়া সংকট। অথবা, ইটালির আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ সমম্পর্কে লেখাে।
উত্তর :- ইটালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসােলিনি নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে ইটালির ভৌগােলিক সম্প্রসারণ ঘটানাের উদ্যোগ নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ইটালি আবিসিনিয়ার উপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মুসােলিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া আক্রমণ করেন এবং পরে তা দখল করেন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে।
পটভূমি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বে যখন মহামন্দা, তখন ইটালি তার অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ আবিসিনিয়া দখলের চেষ্টা শুরু করে। এরকম পরিস্থিতিতে ওয়াল
ওয়াল গ্রামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসােলিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর আবিসিনিয়া আক্রমণ করে।
কারণ : ইটালি কর্তৃক আবিসিনিয়া বা ইথিওপিয়া আক্রমণের প্রধান কারণগুলি ছিল—
[1] আবিসিনিয়ার কাছে ইটালির পরাজয়ের (১৮৯৬ খ্রি.) প্রতিশােধ গ্রহণ।
[2] ইটালির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থান ও কর্মসংস্থান সংক্রান্তসমস্যার সমাধান।
| শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ।।
| শিল্পপণ্য বিক্রির বাজার দখল প্রভৃতি।
জাতিসংঘের ভূমিকা : এই ঘটনায় জাতিসংঘ ইটালিকে ‘আক্রমণকারী দেশ হিসেবে ঘােষণা করে। লিগের বহু দেশ ইটালির। সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
আবিসিনিয়া দখল : ইটালির আক্রমণের চাপে এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে সম্রাট হেইলে সেলাসি দেশত্যাগ করলে আবিসিনিয়া ইটালির অন্তর্ভুক্ত হয়। ইটালি এরপর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে।
গুরুত্ব : ইটালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ও দখল আন্তর্জাতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
[1] এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইটালির উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রকাশ্যে চলে আসে।
[2] জাতিসংঘের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ দেশগুলির আস্ফালন আরও বেড়ে গিয়েছিল।
3। ইটালিতে মুসােলিনির জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
4 আবিসিনিয়া দখলের ঘটনা জার্মান শাসক হিটলারকে ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘনে উৎসাহিত করে।
5 এরপর ইটালি জার্মানির সঙ্গে জোট গড়ে তুললে ইউরােপে নতুন শক্তিজোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War I) কারণগুলি কী কী ছিল?
উত্তর:- ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ২০ বছরের ব্যবধানে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রনেতাগণ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বকে ভয়াবহ যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা— পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণ।
পরােক্ষ কারণ :
ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া : ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাই সন্ধিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিজয়ী মিত্রপক্ষ জার্মানির উপর অপমানজনক ভার্সাই সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল, যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জার্মান জাতির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বরং জার্মান জাতির মধ্যে প্রতিশােধস্পৃহা জেগে উঠেছিল। জার্মানি এই একতরফা ও জবরদস্তিমূলক চুক্তি ভেঙে ফেলার সুযােগের অপেক্ষায় ছিল। তাই ঐতিহাসিক ই এইচ কার যথার্থই বলেছেন যে, ভার্সাই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল।
উগ্র জাতীয়তাবাদ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জার্মানি, ইটালি ও জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি। হেরেনভক তত্ত্বে বিশ্বাসী হিটলার বলতেন, জার্মানরাই হল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। তিনি জার্মানিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। হিটলারের আগ্রাসী নীতির সঙ্গে জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে যে সাম্রাজ্যবাদী নীতির জন্ম হয়েছিল তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ : জার্মানির অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। এই অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদকে চরিতার্থ করতে নাৎসি দলের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে জার্মানিতে প্রাক্-বিশ্বযুদ্ধকালীন সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভার্সাই সন্ধির ফলে জার্মানি তার উপনিবেশগুলি হারিয়েছিল এবং নতুন উপনিবেশ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিল। অপরদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ বৃদ্ধি করেই চলেছিল। এমতাবস্থায় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলি নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তােষণনীতি : ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির প্রতি তােষণনীতি গ্রহণ করেছিল। তারা ভেবেছিল, এভাবে হিটলারকে প্রতিরােধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু তাদের এই কর্মপন্থা হিটলারের আগ্রাসী মনােভাবকে চূড়ান্ত মাত্রা দেয়। তবে এক্ষেত্রে বলা ভালাে, জার্মানির থেকে রাশিয়াকে আরও বিপজ্জনক মনে করেই জার্মানির প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তােষণনীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এই তােষণনীতির ফলে
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির আগ্রাসন আরও বৃদ্ধি পায়।
নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা : জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে (১৯৩৩ খ্রি.) বৃহৎ শক্তিবর্গ জার্মানির অস্ত্রশক্তি হ্রাসে অত্যন্ত উদগ্রীব হলেও তারা নিজেদের অস্ত্রশক্তি হ্রাস করতে রাজি ছিল না। জার্মানি নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সুযােগ না পেয়ে সম্মেলন ত্যাগ করে নিজের ইচ্ছামতাে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা : জাতিসংঘের ব্যর্থতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অপারগ থাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল। ইটালির আবিসিনিয়া অধিকার কিংবা জাপানের মারিয়া
অধিকারের ঘটনায় জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল।
পরস্পরবিরােধী শক্তিজোট গঠন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে পরস্পরবিরােধী শক্তিজোট গঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল। একদিকে জার্মানি, ইটালি, জাপান এই অতৃপ্ত রাষ্ট্রগুলি রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন করেছিল। অপরদিকে জোটবদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গঠন করেছিল মিত্রশক্তি। যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যােগদান করে মিত্রশক্তিকে আরও জোরদার করেছিল।
প্রত্যক্ষ কারণ
হিটলারের পােল্যান্ড আক্ৰমণ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল হিটলারের পােল্যান্ড আক্রমণ।
রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন হওয়ার পর হিটলার ‘পােলিশ করিডর’ দাবি করেন। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই ঘােষণার বিরােধিতা করে পােল্যান্ডের পক্ষ নেবে বলে হুমকি দেয়। এই হুমকি নস্যাৎ করে দিয়ে হিটলার ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর পােল্যান্ড আক্রমণ করেন। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পােল্যান্ডের সঙ্গে সামরিক সাহায্যের শর্তে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তাই ৩ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পােল্যান্ডের পক্ষে ও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
৪. বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা :১১৩১ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রবর্গের পারস্পরিক সম্পর্মের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এই যুদ্ধেই সর্বপ্রথম পারমাণবিক বােমার ধ্বংসলীলার সঙ্গে বিশ্ববাসী পরিচিত হয়েছিল। বিভিন্ন উনি চুক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ চার্চিল বলেন যে, “প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন যদি মিউনিখ চুক্তি দ্বারা সম্মান অর্জন করেন। তাহলে ইংরেজ অভিধানে সম্মান করে অর্থ পরিবর্তন তে হবে। শান্তি তিনি রক্ষাতে পারবেন না।” দেশের সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
সাম্রাজ্যবাদের পতন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যে সাম্রাজ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তা যুদ্ধের পর অনেকাংশে হ্রাস পায়। এই সময় বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্মলাভ করে। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ এই সময় স্বাধীনতা লাভ করে।
অক্ষশক্তির প্রাধান্য হ্রাস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইটালি, জার্মানি ও জাপান অর্থাৎ অক্ষশক্তি যে শক্তি ও প্রাধান্য অর্জন করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তার অবসান ঘটে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মিত্রশক্তি রােম অধিকার করলে ইটালির, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার লাল ফৌজ বার্লিন দখল করলে জার্মানির এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সরকার হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে বােমা নিক্ষেপ করলে জাপানের পরাজয় ঘটে।
বিজয়ী শক্তির উপর প্রভাব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী ইউরােপীয় শক্তির অবস্থা মােটেও ভালাে ছিল না। জনবল, জাতীয় সম্পদ,শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কায় ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি বিজয়ী শক্তিগুলির অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙে পড়ে।
জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে জাতিসংঘের পতন হয় এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠা হয়।
আর্থিক পুনর্বাসন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র পৃথিবীতে কমবেশি আর্থিক প্রভাব ফেলেছিল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে সচল করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের
নভেম্বরে আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরে ‘জাতিপুঞ্জ ত্রাণ ও পুনর্বাসন’ বা ‘UNRRA
(United Nations Relief and Rehabiliation Administration) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সাহায্যের ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন, কৃষি ও শিল্পের পুনরুজ্জীবন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি সম্ভব হয়।
দ্বি-মেরু বিশ্বের আবির্ভাব : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যেমন ইউরােপ মহাদেশের একক প্রাধান্য
হ্রাস করে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রবর্গকে (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রুশ বাহিনী কর্তৃক বলিন বল গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল, ঠিক তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সােভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্ব দুটি পরস্পরবিরােধী গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুই গােষ্ঠীর একদিকে ছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং অপরদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া আলােচ্য পর্বে ভারতের নেতৃত্বে এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে নিয়ে জোটনিরপেক্ষ
গােষ্ঠী গড়ে উঠেছিল।
আমেরিকার আধিপত্য : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র আমেরিকা সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে যুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করে।
ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সােভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হয়। তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থায় জার্মান আক্রমণের চাপ কমানাের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খােলার আবেদন জানায়। কিন্তু আবেদন গ্রাহ্য না হওয়ায় তখন থেকেই আমেরিকা ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অবিশ্বাস ও পারস্পরিক উত্তেজনা শুরু হয়। এরপর প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ফুলটন বক্তৃতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরমাণু শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার এবং সােভিয়েত লাল দস্যুদের আক্রমণ থেকে ইউরােপীয় সভ্যতাকে রক্ষার আহ্বান জানান। এর ফলে ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা হয়।
জাতীয়তাবাদের বিকাশ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক দেশগুলির সাফল্য। ফলে গণতন্ত্র জয়যুক্ত হলে সমগ্র বিশ্বে নতুন আবহের সূত্রপাত হয়। সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্রে বিভক্ত পৃথিবীর মেরুকরণে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা গড়ে উঠতে থাকে এই সময় বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে।
তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মতাে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধের প্রভাবে উপনিবেশগুলিতে জনজাগরণ ঘটে এবং অনেক উপনিবেশ স্বাধীন হয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় এই সদ্য স্বাধীন দেশগুলি নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব হয়।
পরমাণু যুগের সূচনা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পরমাণু বােমা তৈরি ও ব্যবহার করে। এরপর সােভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু শক্তিধর হয়। একে একে অনেক দেশ পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে। শুরু হয় পরমাণু অস্ত্র প্রতিযােগিতা।
*উপসংহার : এই সমস্ত বিষয়গুলি ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্ভূত পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তির ক্ষেত্রে সমস্যা, ঔপনিবেশিক সমস্যা, মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণের সমস্যা প্রভৃতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুদূরপ্রসারী ফল ছিল আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসলীলা থেকে মানবজাতি যে শিক্ষা নিয়েছিল, তার কারণেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আজও স্থগিত রয়েছে।
No comments:
Post a Comment